কবির কল্পনাকে আক্ষরিক অর্থে সত্য ভাবিয়া লইলে মহা বিপদ হইতে পারে। বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশকে সুজলা, সুফলা বলিয়াছিলেন। সেই বর্ণনা কবির, কৃষিবিজ্ঞানীর নহে। কিন্তু, কালক্রমে বর্ণনাটি আপ্তবাক্যে পরিণত হইয়াছে। দেখা যাইতেছে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীও তাহাতে বিশ্বাসী। পশ্চিমবঙ্গকে সুফলা বলা চলিতেই পারে, কিন্তু তাহা রাজস্থানের তুলনায়। চিন, ব্রাজিল, বা ভিয়েতনাম যে অর্থে সুফলা, পশ্চিমবঙ্গের জমির উৎপাদনশীলতা তাহার অংশমাত্র। উৎপাদনশীলতা কম হওয়ার বিবিধ কারণ রহিয়াছে, জমির গুণগত মান তাহার একটি। পশ্চিমবঙ্গ যে সুজলা, সে বিষয়ে অবশ্য সংশয়ের অবকাশ নাই। এবং তাহাতেই এক বিপদ হইয়াছে। জলের ব্যবহার সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সচেতনতাও এই রাজ্যে তৈরি হয় নাই। তাহা কেবল কৃষকের দোষ নহে। গত শতকের আশির দশকে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার যে নিজস্ব সবুজ বিপ্লবের আনন্দে মশগুল ছিল, তাহার ভিত্তি ছিল ভূগর্ভস্থ জলের তুমুল অপব্যবহার। আজ তাহার ফল মিলিয়াছে। কৃষির উৎপাদনশীলতা স্থবির, কিন্তু আর্সেনিক দূষণ লাফে লাফে বাড়িতেছে। এই ‘সুজলা’ রাজ্যের কথা বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন নাই।
এক দিকে প্রকৃতির মার, অন্য দিকে রাজনীতির। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি জোত ঐতিহাসিক ভাবেই ক্ষুদ্র। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসিয়া সেই ক্ষুদ্র জোতগুলিকেও বহু খণ্ডে ভাঙিয়াছিল। ভূমি সংস্কারের নামে সেই প্রক্রিয়াটি পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পথটি পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। ক্ষুদ্র জোতবিশিষ্ট রাজ্যে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করিবার একটিই রাস্তা আছে সমবায়। কিন্তু, যে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস আর সি পি আই এম সমর্থকদের মধ্যে জলচল নাই, সেখানে সমবায় চাষের কথা ভাবাও অবান্তর। দুই তরফের মার খাইয়া পশ্চিমবঙ্গের কৃষি আপাতত কোণঠাসা। অনুমান করা চলে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কৃষিকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন। তিনি কৃষিকে ‘সম্পদ’ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। মুখে যাহাই বলুন, ঘোর সন্দেহ হয় যে, শিল্পে তাঁহার মন নাই, তিনি কৃষিকেই রাজ্যের অর্থনীতির মূলস্রোত করিয়া তুলিতে চাহেন। রাজ্যের কৃষি বর্তমানে যে অবস্থায়, তাহাতে এই বাসনার নিহিতার্থ রাজ্যে শিল্পায়ন করিতে যে পরিশ্রম করিতে হইত, তাহার তুলনায় ঢের বেশি পরিশ্রমের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। আর, মুখ্যমন্ত্রীর বাসনাটি ফলপ্রসূ হইলে তাহার পরিণাম পশ্চিমবঙ্গ কখনও দেশের অগ্রগণ্য আর্থিক শক্তি হইয়া উঠিতে পারিবে না। কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর শত সদিচ্ছা, সহস্র উদ্যোগও কৃষিকে এমন শক্তিশালী করিতে পারিবে না যে শুধু তাহার জোরেই শিল্পায়িত রাজ্যগুলির সহিত টক্কর দেওয়া যাইতে পারে।
ধরিয়া লওয়া যাক, মুখ্যমন্ত্রীর শ্রমে আপত্তি নাই, আর অগ্রগণ্য আর্থিক শক্তি হওয়ায় রুচি নাই। কৃষিই তাঁহার ভবিষ্যৎ। যদি তাহাই হয়, তবে পরিকল্পনা কোথায়? কী ভাবে জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়, কৃষিতে কতখানি জল ব্যবহার করিলে তাহা সুস্থায়ী হয় এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা কোথায়? অমিত মিত্রের বাজেটে কৃষকের মন ভুলাইবার চেষ্টা আছে, কিন্তু কৃষি গবেষণার উন্নতিসাধনের কথা নাই। যে ধান চাষ করা জলের ভাণ্ডারের পক্ষে সুস্থায়ী নহে, প্রয়োজনে সেই চাষ বন্ধ করিতে হইবে। জমিতে বার বার একই ফসল ফলাইলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, দুইটি চাষের মধ্যে এক বার ডাল চাষ করিলে জমির উর্বরতা বাড়ে এই কথাগুলি সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকেও আছে। তাহার প্রয়োগ চাই। প্রয়োজনে এক মরসুম চাষ না করিয়া জমি ফেলিয়া রাখিতে হইবে। এই সব ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি জরুরি, তাহা দেওয়াও উচিত। কিন্তু তাহার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি চাই, বড় ছবিটি দেখিতে পারার মানসিকতা চাই। দুর্ভাগ্যক্রমে, রাজ্যের শাসকরা সেই মানসিকতার প্রমাণ দিতে পারেন নাই। |