|
|
|
|
|
অবাধে ছুটছে অনধিকার লালবাতি,
জরিমানা ১০০ টাকা, তোয়াক্কাই করে না কেউ
অশোক সেনগুপ্ত • কলকাতা |
|
পার্কসার্কাস মোড় দিয়ে হু-হু করে বেরিয়ে যাচ্ছিল লালবাতি লাগানো গাড়িটা। পুলিশ অন্য গাড়ির আগে বের করে দিল সেটিকে।
গাড়িটি কোনও মন্ত্রী, বিচারপতি কিংবা রাজ্য প্রশাসনের কর্তার নয়। সেটির আরোহীর নাম খালিদ আবদুল্লা। পদাধিকার বলে ওয়েস্ট বেঙ্গল কো-অপারেটিভ স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান।
লালবাতি লাগানো একটি গাড়ি দেখে হাতিবাগানের মোড়ে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশ স্যালুট দিলেন। নেহাৎই অভ্যাস বশে। ভিতরে কে বসে, জানেনই না তিনি।
গাড়ি থেকে নেমে আসার পরে চেনা গেল তাঁকে। পার্থপ্রতিম হাজারি। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ।
ডায়মন্ড হারবার রোড দিয়ে যে গাড়িটি লালবাতি লাগিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছিল তাঁর আরোহীর পরিচয় পুলিশের জানা। তিনি দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের চেয়ারম্যান তমোনাশ ঘোষ।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ তথা রাজ্য সরকারের আইন মোতাবেক ওই চার সওয়ারির এক জনেরও কিন্তু গাড়িতে লালবাতি ব্যবহারের এক্তিয়ার নেই। ওই চারটি গাড়ি নমুনা মাত্র। সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মেয়র পারিষদ থেকে বিধায়ক, বিভিন্ন সরকারি পর্ষদের চেয়ারম্যান থেকে নিচুতলার প্রশাসনিক কর্তা, এমনকী ধর্মীয় নেতারাও ব্যবহার করছেন লালবাতি। এমন গাড়ির অবাধ গতি কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যেই।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে গাড়িতে কারা লালবাতি লাগাতে পারবেন, সে ব্যাপারে ২০০৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মহাকরণ থেকে একটি নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়। তাতে বলা আছে, ৪০ ধরনের পদাধিকারী গাড়িতে লালবাতি ব্যবহার করতে পারবেন। তা-ও শুধু সরকারি কাজের সময়টুকু। তিনি গাড়িতে না থাকলে বাতি ঢেকে রাখতে হবে।
আরোহীর যে লালবাতি ব্যবহারের এক্তিয়ার আছে, সেই সংক্রান্ত শংসাপত্র গাড়িতে সেঁটে রাখার কথাও বলা আছে নির্দেশিকায়। ধরতাই হিসেবে গোড়াতেই যে চারটি গাড়ির কথা বলা হল, সেগুলির একটিরও কিন্তু সেই শংসাপত্র নেই। থাকবে কী করে? কারণ, ওই চার ব্যক্তি যে পদে রয়েছেন, তাতে লাল আলো ব্যবহার করা যায় না।
এ ব্যাপারে কী বলছেন লালবাতি-গাড়ির ওই চার সওয়ারি?
খালিদ আবদুল্লার ব্যাখ্যা, “পুরসভার মেয়র পারিষদরাও তো গাড়িতে লাল বাতি লাগাচ্ছেন!” কিন্তু তিনি নিজের গাড়িতে লালবাতি লাগাচ্ছেন কোন নিয়মে? আবদুল্লা বলেন, “বিভাগীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জবাব দেব।”
|
অধিকারী কারা |
‘ফ্ল্যাশার-সহ’ লালবাতি |
তালিকায় ১৩ |
• রাজ্যপাল
• মন্ত্রী
• হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি
• ‘পুসিন’ (অর্থাৎ জুনিয়র) বিচারপতি
• বিধানসভার স্পিকার • ডেপুটি-স্পিকার
• বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা
• রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল
• ভারতরত্নরা যাঁদের অন্যতম
|
‘ফ্ল্যাশার-বিহীন’ লালবাতি |
তালিকায় ২৭ |
• মুখ্যসচিব
• রাজ্যের নানা দফতরের সচিব
• ৩টি নির্দিষ্ট ট্রাইব্যুনাল ও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান
• ডিভিশনাল কমিশনার
• রাজ্য পুলিশের ডিজি
• এডিজি
• নিজের এলাকায় কলকাতার সিপি
• আঞ্চলিক আইজি এবং ডিআইজি
• মুখ্য নির্বাচনী অফিসার
• পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান
• বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
• ভিজিল্যান্স কমিশনার
• নিজের এলাকায় জেলা পরিষদের সভাধিপতি
• অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল প্রমুখ। |
|
|
কলকাতা পুরসভার মেয়র, ডেপুটি মেয়র এবং চেয়ারম্যান কেবল পুর-এলাকায় গাড়িতে লালবাতি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মেয়র পারিষদ ব্যবহার করছেন কোন নিয়মে? পার্থপ্রতিমবাবুর পাল্টা প্রশ্ন “কেবল আমাকেই কি এই প্রশ্ন করছেন? গুটিকয় লোক ছাড়া ক’জনই বা এই বাতি লাগাতে পারেন?” তাঁর দাবি, গাড়ির ওই লালবাতি জ্বালানো হয় না। তবে তা ঢেকে রাখছেন না কেন? পার্থবাবুর জবাব, “জ্বালাই না যখন, ঢাকা আর না-ঢাকার পার্থক্য কোথায়?”
তমোনোশবাবু অবশ্য জানেন যে তিনি লালবাতি ব্যবহার করতে পারেন না। তা হলে ব্যবহার করছেন কেন? দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক বলেন, “শহরে এই বাতি সচরাচর জ্বালাই না। জাতীয় সড়কে জ্বালাই। তাতে সুবিধা হয়।” এক্তিয়ারের প্রশ্নে বলেন, “এটা আইনি না বেআইনি, খতিয়ে দেখিনি। আমার পূর্বসূরিদের দেখেছি গাড়িতে লালবাতি লাগাতে।”
কথাটা সত্যি। রোগটা দীর্ঘদিনের। গাড়ির গয়নাগাটির দোকান থেকে যে কেউই কিনে আনতে পারেন লালবাতি। দরকার শুধু, অন্যায় ভাবেও লালবাতির ‘খাতির’ পাওয়ার লোভ। যা রোখার জন্য বিধি আছে পরিবহণ দফতরের। কিন্তু তাদের বক্তব্য, কেউ বিধি ভাঙলে তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের।
কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন যে বেআইনি ভাবে লালবাতি লাগিয়ে প্রচুর গাড়ি ঘুরছে। তিনি বলেন, “রাস্তায় যে সব গাড়ির উপরে লালবাতি দেখা যায়, সেগুলির নম্বর আমরা নথিভুক্ত করছি। একটি প্রাথমিক তালিকাও তৈরি হয়েছে। এই তালিকার সঙ্গে কারা কারা গাড়িতে এই বাতি ব্যবহার করতে পারেন, সেই তালিকা খতিয়ে দেখা হবে। এক্তিয়ারবিহীন গাড়িগুলোকে নোটিস দেওয়া হবে।”
যদিও রাজ্য পুলিশের ডিজি (ট্রাফিক) গৌতমমোহন চক্রবর্তী স্বীকারই করে নিলেন, “কারা কারা গাড়িতে এই বাতি ব্যবহারের অধিকারী, তা বাছাই করে আইন-ভঙ্গকারীদের সাজা দেওয়ার কাজটা সে ভাবে হয় না।”
সেই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিলেন এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে করুণ তথ্যটি। তা হল, “লালবাতির বিধি ভাঙা হয়েছে প্রমাণ হলে জরিমানা মাত্র ১০০ টাকা! তাই এ ব্যাপারে লোকের ভয়টাও নেই।” |
|
|
|
|
|