মুর্শিদাবাদের পরে এ বার নদিয়া আর উত্তর ২৪ পরগনা।
রাজ্যের আরও দুই জেলা পরিষদের আর্থিক দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে যে তিনটি জেলা পরিষদের আর্থিক কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্ব জেলাশাসকদের হাতে তুলে দেওয়া হল, সেই তিনটি জেলা পরিষদই বামফ্রন্টের নিয়ন্ত্রণে। সুব্রতবাবুর দাবি, এই সব জেলা পরিষদে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। উন্নয়নের কাজ থমকে গিয়েছে। অথচ আর্থিক বছর শেষের মুখে। উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা যাতে ফেরত না যায়, সেই জন্যই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাজেট পাশ না-হওয়ায় উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনসল এবং নদিয়ার জেলাশাসক অভিনব চন্দ্রার হাতে জেলা পরিষদের আর্থিক দায়দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে পঞ্চায়েতমন্ত্রী বলেন, “এর আগে মুর্শিদাবাদেও আমি জেলাশাসককে একই নির্দেশ দিয়েছি। এই ধরনের পরিস্থিতি হলে পঞ্চায়েত আইন অনুসারে আর্থিক বছরের পরিকল্পনা, ব্যয়-বরাদ্দ এবং অর্থ খরচের যাবতীয় দায়িত্ব জেলাশাসকের হাতে তুলে দিতে হবে।”
উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সভাধিপতি ভরত দাসের অবশ্য দাবি, গত ১৬ মার্চেই তাঁরা বাজেট পাশ করিয়েছেন। তাঁর কথায়, “ওই দিন সাধারণ সভায় বাজেট পেশ করা হয়। তার পর তা পাশও হয়েছে। এর পরেও কেন এই সিদ্ধান্ত বুঝতে পারছি না। এটা অস্বাভাবিক।” এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য সুব্রতবাবুকে অনুরোধ জানিয়েছেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। অনুরোধ রক্ষা করা না-হলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ বাজেট পাশের দাবি করলেও নদিয়া জেলা পরিষদ অবশ্য সোমবারও বাজেট পাশ করাতে পারেনি। এ দিন সাধারণ সভায় ভোটাভুটিতে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট হেরে যায়। জেলাশাসক বলেন, “ভোটাভুটিতে ক্ষমতাসীন দল হেরে যাওয়ায় বাজেট পাশ হয়নি।”
নদিয়া জেলা পরিষদে ক্ষমতায় থাকলেও বিধানসভা ভোটের পরে সাধারণ সভায় বামফ্রন্ট সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। জেলা পরিষদে মোট আসন ৪৫টি। এর মধ্যে বামফ্রন্টের সদস্য ৩৪ জন। কংগ্রেসের ৪ জন। তৃণমূলের ৭ জন। তবে বামফ্রন্টের এখন সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০-এ। সিপিএমের দুই সদস্য মারা গিয়েছেন। এক জন ইস্তফা দিয়েছেন। এ ছাড়া, বিধায়ক হয়ে যাওয়ার ফলে জেলা পরিষদের আসন থেকে পদত্যাগ করেছেন সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ। তবু জেলা পরিষদ বামফ্রন্টেরই দখলে। কিন্তু সাধারণ সভায় জেলা পরিষদের সদস্যরা ছাড়াও ভোট দিতে পারেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সাংসদ এবং বিধায়করাও। সে ক্ষেত্রে দু’টি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও তিন বিধায়ককে নিয়ে বামফ্রন্টের সদস্য সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৩৫। উল্টো দিকে, কংগ্রেস ও তৃণমূলের মিলিত সদস্য সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৪৩। তার মধ্যে ৭ জেলা পরিষদ সদস্য, পঞ্চায়েত সমিতির ৯ জন সভাপতি, ১২ জন বিধায়ক এবং ৩ সাংসদকে নিয়ে সাধারণ সভায় তৃণমূলের মোট সদস্য ৩১ জন। সাধারণ সভায় কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা ১২। তার মধ্যে পঞ্চায়েত সমিতির ৬ জন সভাপতি, জেলা পরিষদের ৪ সদস্য, এক জন বিধায়ক ও এক জন সাংসদ। তবে এই দিন সভায় এসেছিলেন বামফ্রন্টের ২৮ জন, তৃণমূলের ২৮ জন এবং কংগ্রেসের ৯ জন।
এ দিন সভার শুরুতেই বাজেটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন কংগ্রেস ও তৃণমূলের সদস্যরা। শেষে ভোটাভুটিতে বামফ্রন্ট হেরে যায়। জেলা পরিষদের সভাধিপতি সিপিএমের মেঘলাল শেখ বলেন, “পুরো বিষয়টি পূর্ব পরিকল্পিত। জেলার উন্নয়ন চাইলে কেউ এ কাজ করতেন না।” তবে সাধারণ সভার সদস্য তথা নবদ্বীপের বিধায়ক তৃণমূলের পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা বলেন, “এই বাজেট পাশ করলে জেলার
মানুষের ক্ষতিই হত। এটি অপরিকল্পিত ও ভিত্তিহীন বাজেট।” আর এক সদস্য শান্তিপুরের বিধায়ক কংগ্রেসের অজয় দে বলেন, “গত বছর বহু টাকা জেলা পরিষদ খরচ করতে পারেনি। এ বারের বাজেটেও নানান অসঙ্গতি ছিল।”
উত্তর ২৪ পরগনার পরিস্থিতিও একই রকম জটিল। জেলা পরিষদের ৫১টি আসনের মধ্যে ২৭টি বামেদের দখলে। ২৪টি বাম বিরোধীদের। এক সিপিএম সদস্য পদত্যাগ করায় ও এক তৃণমূল সদস্যকে বহিষ্কার করায় ২টি আসন খালি। জেলা পরিষদের সাধারণ সভার অতিরিক্ত সদস্যের মধ্যে রয়েছেন ২২টি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, যাঁদের ১৯ জনই বাম-বিরোধী, ৪ তৃণমূল সাংসদ ও ১৪ জন বাম-বিরোধী বিধায়ক। ফলে সাধারণ সভায় বাম-বিরোধীরাই সংখ্যাগুরু। যার জেরে ৪ মাস ধরে বাজেট পাশ নিয়ে টালবাহানা চলছে। জেলা পরিষদের উন্নয়নমূলক কাজকর্ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয় যারা, সেই স্থায়ী সমিতিগুলি নিয়েও জটিলতা তুঙ্গে। তৃণমূলের দাবি, সমিতিগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে বামেরা। হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করে। কিন্তু ৪ মাস ধরে স্থায়ী কমিটির কোনও বৈঠক হতে পারছে না বলে অভিযোগ।
সুব্রতবাবু বলেন, “এই সব জেলা পরিষদে উন্নয়নমূলক কাজ সম্পূর্ণ স্তব্ধ। জেলা পরিষদ ভেঙে দিতে পারতাম। কিন্তু ভাঙিনি। শুধু রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা ও বেতন-পেনশন ইত্যাদি বণ্টনের দায়িত্ব জেলাশাসকের হাতে দিয়েছি। তিনি তো আর তৃণমূলের লোক নন। প্রশাসনিক ব্যক্তি।” পঞ্চায়েতমন্ত্রীর সরস মন্তব্য, “ওঁদের পদ বা লাল বাতি লাগানো গাড়ি তো কেড়ে নিচ্ছি না। তেলের টাকা জেলাশাসকের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।”
উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক রাতে বলেন, “রাজ্যের তরফে কয়েকটি জিনিস দেখার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক বিষয়গুলি দেখভালের জন্য আমার নেতৃত্বে কয়েকটি কমিটি গঠিত হবে।” নদিয়ার জেলাশাসক অবশ্য জানিয়েছেন, এ রকম কোনও নির্দেশ তাঁর কাছে এসে পৌঁছয়নি। জেলা সভাধিপতিও বলেন, “এখন অব্দি এমন কোনও নির্দেশ এসেছে বলে আমার জানা নেই। তবে রাজ্য সরকার এমন পদক্ষেপ করলে তা হবে ঘোর বেআইনি।”
মুর্শিদাবাদেও আগেই এমন বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে বলে জানান সুব্রতবাবু। যদিও জেলাশাসক রাজীব কুমার বা সভাধিপতি পূর্ণিমা দাস এমন আদেশনামার কথা জানেন না বলে সোমবার দাবি করেছেন। সিপিএমের বক্তব্য, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে শনিবারেই তারা জেলা পরিষদের বাজেট পাশ করেছে। বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীও বলেন, “এই জেলাটার নাম মুর্শিদাবাদ। একমাত্র এই জেলাতেই বড় শরিক তৃণমূলের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি কংগ্রেস। আমরা সিপিএমের সঙ্গে বাজেট পাশ করিয়েছি জেলার উন্নয়নের জন্যই।”
সুব্রতবাবুর দাবি, “সারা বছর যাঁরা পরস্পরের বিরোধিতা করেন তাঁরা শুধু বাজেট পাশের সময় একজোট হলেন, এ ভাবে জোড়াতালি দিয়ে জেলা পরিষদের কাজ চালানো যায় না। জেলা পরিষদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বটাই তো থাকবে না।” আইনি পথে হাঁটার পাশাপাশি আন্দোলনেও নামছে সিপিএম। আজ, মঙ্গলবার, দুপুরে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসকের দফতরে বিক্ষোভ দেখাবে তারা। |