ইস্টবেঙ্গল-১ (টোলগে)
সালগাওকর-০ |
মিলান মাকালা— বয়স ৬৮। চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাক্তন জাতীয় কোচ এখন কুয়েতের কাজমা স্পোটিংয়ের ম্যানেজার। ফুটবল বিশ্বে শ্রদ্ধেয় লোক।
কুয়েতে ইস্টবেঙ্গলকে তিন গোলে ধ্বংস করে ট্রেভর মর্গ্যানকে অযাচিত এক পরামর্শ দিয়েছিলেন মাকালা।
টোলগের যা স্টাইল, তাতে উইংয়ে না খেলিয়ে মাঝখানে খেলালে ও আরও কার্যকর হবে।
সালগাওকর ম্যাচের শুরুতে দেখা গেল, টোলগে একেবারে টিপিক্যাল স্ট্রাইকার পজিশনে। মাকালার পরামর্শ একটা কারণ। অন্য কারণ, সালগাওকরের ব্রাজিলিয়ান স্টপার লুসিয়ানো। যিনি দারুণ শক্তিশালী, কিন্তু গতিতে মন্থর। একমাত্র গতিময় টোলগেই তাঁর ওষুধ হতে পারে।
দুই আদত স্ট্রাইকার রবিন এবং বলজিৎ সিংহ উইংয়ে সরে। টোলগে মাঝে। প্রথম দিকে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল এলোমেলো, বিপর্যস্ত। ৪-৪-২ এর ভক্ত মর্গ্যান সম্প্রতি নানা রকম ছকে টিমকে খেলাচ্ছেন। এ এফ সি কাপে ৪-৫-১ ছকে খেলানোর পরে রবিবার হঠাৎ ৪-৩-৩। টোলগে প্রথমে একদম স্ট্রাইকার। সামান্য পরে উইঙ্গার। তাঁর প্রথম আক্রমণ নোটবুকে উঠল ৪০ মিনিট পেরোনোর পরে। অমল দত্ত থাকলে মজা করতেন, “ওরে ও টোলগে, তোমার স্পিড কোথায় গেল?”
বিরতির পরে ইস্টবেঙ্গল পুরনো ছকে ফিরল। টোলগে ফিরলেন তাঁর পুরনো জায়গায়। সালগাওকরের পাসিং ফুটবলটা অদৃশ্য হয়ে গেল। চিডি-সুয়োকা-টোম্বার ত্রিভুজ এতক্ষণ ক্রমাগত আতঙ্কের জ্যামিতি তৈরি করছিল ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্সিভ থার্ডে। কেউ যেন সেই ত্রিভুজের একটা বাহু রবার দিয়ে মুছে দিল। জ্যামিতির খাতায় যেমন হয়। |
ইদানীং মর্গ্যানের প্র্যাক্টিসে গেলে চোখে পড়ে, ছোট্ট জায়গায় তিন টাচের ফুটবল খেলছে দল। গ্রাউন্ড পাস, গ্রাউন্ড পাস। স্রেফ পাসিং স্টাইল বদলাতে। মর্গ্যানের সমালোচকরা বলেন, তিনি পুরনো ব্রিটিশ লং বল স্টাইল থেকে বেরোতে পারেননি। বড় ম্যাচে সাফল্য কম। শেষ ৯ ম্যাচে হার ছিল ৪। জয় ৩— তা আবার ভবানীপুর, লাজং, পৈলানের বিরুদ্ধে। সম্ভবত ওই অপবাদ মোছার প্রবল চেষ্টায় ব্রিটিশ-অস্ট্রেলিয়ান কোচ। পাসিং ফুটবলের হাত ধরে। দ্বিতীয়ার্ধে ছোট পাসের ঝলকানি বেরোতেই ইস্টবেঙ্গল ছায়া থেকে রোদে ফিরল। দশ মিনিটের ভিতরে রবিনের সেন্টার থেকে টোলগের দুর্দান্ত হেডে গোল। টোলগে যা নিয়ে বললেন, “মরসুমে আমার সেরা গোল।” ওই গোলের জন্যই ইস্টবেঙ্গল ফের দুই নম্বরে। মর্গ্যান গোলটার পরে আবার চলে গেলেন ৪-৪-২ ছকে।
দুটো নিশ্চিত গোল নষ্ট করা টোলগের মন্থরতা দেখে প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল, দলবদলের ফোন, এসএমএস, পাঁচ তারা হোটেলে মিটিং প্রভাব ফেলেছে খেলায়। তিনি নন, পরিশ্রম আর গতিতে তখন চোখ টানছেন চিডি। যেন লাল হলুদ কর্তাদের দেখাচ্ছেন, র্যান্টি-ওডাফার চেয়ে আমি কম নই। আমাকে নিতেই হবে পরের বার। দ্বিতীয়ার্ধে নিজেকে খুঁজে পেলেন পুরনো টোলগে। টলির পুরনো জুটি রলিও (রবিন) দেখা গেল, পায়ে বল রাখার পুরনো অভ্যাস থেকে মুক্ত। গোলের পাসটাও ওই অভ্যাসমুক্তির ফল। রবিনের সিটার নষ্টের অপরাধ ভুলে যাওয়া যায় ওই পাসটা দেখে।
ইস্টবেঙ্গলের এক গোলকিপার যুবভারতীতে ক’দিন আগেই তৈরি করেছিলেন প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ। যে প্রয়াগ ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে আগের ম্যাচে ডুবিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেই দুর্দান্ত খেলে। নাম গুরপ্রীত সিংহ। এ দিনের যুবভারতী দেখল ইস্টবেঙ্গলের আর এক কিপার সন্দীপ নন্দীর সফল প্রত্যাবর্তন।
সালগাওকর সামনে পড়লেই সন্দীপের কপালে দুর্ভোগ নেমেছে এ বছর। ফেড কাপ ফাইনালে ভুল। গোয়ায় আই লিগে চার গোল। ওই ম্যাচটার পরে আই লিগে তাঁকে খেলানোই হয়নি। গুরপ্রীতের ফর্ম খারাপ বলে এ দিন হঠাৎ নামানো হয় সন্দীপকে। প্রথম মিনিটেই চিডির ওয়ান টু ওয়ান সেভে সন্দীপ রক্ত সঞ্চালন করেন টলোমলো ডিফেন্সে। তরুণ গুরপ্রীত যা পারেননি, অভিজ্ঞ সন্দীপ সেটা করলেন। পুরো টিমকে ধীরে ধীরে তুলে দিলেন উপরে। গোলকিপার কোচ অতনুকে যা দেখে তৃপ্ত দেখাল। সালগাওকরের চিডি ও সুয়োকা দৌড়নোর জন্য জমি পেলেন না। পেন, সঞ্জু, টোলগে, রবিনদের সামনে তখন অনেক দৌড়নোর জমি।
করিম বেঞ্চারিফার কপাল সত্যিই খারাপ! সালগাওকর কোচ খেলাটা দেখলেন ভি আই পি বক্সে বসে। তাঁর ভাষায়, ‘খাঁচায় বসে’। হাতে মোবাইল। সহকারী মারিও সোরেসকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ফোনে। মারিও বলছিলেন টিডি পিটার ভালেসকে। সমান সমান ম্যাচে ওই ভাবে দলকে চালানো কঠিন। সেটা ম্যাচ গড়াতেই বোঝা গেল। দুই অর্ধে চিডি ও গিলবার্টের দুটো গোল অফসাইডের জন্য বাতিল হল। একটা নিয়ে সন্দেহ আছে। ৬৮ মিনিটে রাজু গায়কোয়াড় যে বক্সে হ্যান্ডবল করলেন, তা পেনাল্টি দিলে কিছু বলার থাকত না। পরিষ্কার হ্যান্ডবল।
এই ম্যাচের তামিল রেফারি সি আর শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে চিন থেকে উড়ে এসেছিলেন এ এফ সি ইনস্ট্রাক্টর লিং। শ্রীকৃষ্ণর ফিফা এলিট রেফারি হওয়ার পরীক্ষা ছিল মর্গ্যান-করিমের যুদ্ধ। ম্যাচ শেষে তাঁর দিকে ছুটে গেলেন সালগাওকরের অনেকে। দুটো গোল বাতিলের চেয়েও তাঁদের ক্ষোভ পেনাল্টি না দেওয়ায়।
মনে হল, ওই হ্যান্ডবলের রেশ অনেক দিন থাকবেই। মর্গ্যানের যুক্তি, “বল হাতে লাগতে পারে। কিন্তু ইচ্ছে করে লাগায়নি। বল বাউন্স করে লেগে গেছে। তাই পেনাল্টি নয়।” করিম সেখানে নিজস্ব ভঙ্গিমায় বিদ্রুপাত্মক, “এগারোটা ম্যাচ টানা অপরাজিত ছিলাম। এই ম্যাচেও থাকতে পারতাম। কিন্তু কূটনীতির ঢংয়েই বলছি, রেফারিরাও মানুষ। ভুল হতেই পারে।” এ আই এফ এফে ম্যাচের সিডি দেওয়ার কথা তাঁর মুখে। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে মর্গ্যানের কথা শুনে হাসলেন, “শুনলাম, উনি বলেছেন, হ্যান্ডবল ছিল। হ্যান্ডবল ইজ হ্যান্ডবল, তাই না?”
হ্যাঁ, অবশ্যই হ্যান্ডবল হল হ্যান্ডবল। কিন্তু তার মধ্যে একটা বড় ‘যদি’ আছে। যদি রেফারি মনে করেন, ওটা ইচ্ছাকৃত, তা হলেই হ্যান্ডবল। ফুটবলের বিখ্যাত ‘লজ অব দ্য গেম’ বইয়ের ১২ নম্বর ধারায় ঠিক পাঁচটা কারণ দেখানো হয়েছে, কোনটা ইচ্ছাকৃত হ্যান্ডবল। অত কে দেখতে যাবে? সব দেশেই বক্সে হ্যান্ডবল মানেই বিতর্ক।
ম্যাচের কৃত্রিম স্কোরটা সবাই দেখতে পাচ্ছে। ইস্টবেঙ্গল ১ : সালগাওকর ০।
আসল স্কোরটা কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। মর্গ্যান ১: করিম ০।
পরের মরসুমে ইস্টবেঙ্গল কোচের নামটা হয়তো রবিবারের যুবভারতীই পুরোপুরি নিশ্চিত করে দিয়ে গেল।
|
ইস্টবেঙ্গল: সন্দীপ, সৌমিক, ওপারা, রাজু, নির্মল, সঞ্জু, পেন, হরমনজিৎ, বলজিৎ (সুবোধ), টোলগে, রবিন। |