অবসর নিয়ে উপদেশে কান দিতে নারাজ
শত সেঞ্চুরির পরেও রক্তক্ষরণ সচিনের
ক্রিকেটজীবনের সব চেয়ে গৌরবজনক মুকুট মাথায় তোলার মুহূর্তে উচ্ছ্বাস নয়। উল্টে সচিন তেন্ডুলকরের মধ্যে কাজ করছিল বুক ভরা অভিমান!
গোটা ক্রিকেট-পৃথিবীর মনোযোগ যখন তাঁর সম্ভাব্য উৎসবপালনের ভঙ্গির ওপর আবদ্ধ, তখন মীরপুর ক্রিকেট মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়িয়েই চিরআরাধ্য ক্রিকেটদেবতাকে তিনি কিনা অস্ফুটে তীব্র অভিযোগ পেশ করছিলেন; এত কষ্ট কেন দিলে আমায়? কেন এমন অসহনীয়, যন্ত্রণাকাতর সব ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার সামনে নিয়ে ফেললে? কী দোষ ছিল আমার? এত পরিশ্রম করেও কোথায় বিচ্যুতি ঘটল আমার যে, হয়রান হয়ে মাসের পর মাস ঘষটাতে হল?
ক্রিকেটদেবতার প্রতি তেন্ডুলকরের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে তাঁর চরমতম সমালোচকেরও সংশয় নেই। কাছ থেকে যে সম্প্রদায় নিয়ত দেখেন, তাঁদের হয়ে তো মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বলেই দিয়েছেন, “ক্রিকেট যদি রাম হয় সচিন হনুমান। নিশ্চিত ভাবে রামের সবচেয়ে বড় পূজারি।” আর সচিন এমনই ধর্মভীরু এবং বরাবরের সংস্কারাচ্ছন্ন যে, সর্বশক্তিমানের কাছে কী চান বরাবর গোপন রেখেছেন।
সেই তিনি জনা কুড়ি সাংবাদিকের সামনে যখন রবিবাসরীয় ভরদুপুরে ক্রিকেটদেবতা সম্পর্কে গোপন অনুযোগের কথা বলছিলেন, গোটা ঘর নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল। একটা প্লাস্টিক প্যাকেট পড়লেও তখন শোনা যেত। কিন্তু সচিন যেন সে সব ভাবনার মধ্যে নেই। শততম সেঞ্চুরি যত আকাশছোঁয়া সম্মানই দিক, মনে হল যন্ত্রণার একটা চিপ-ও শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যাবতীয় ঐশ্বর্য প্রাপ্তির মধ্যেও সেখানে হাত পড়লে রক্তপাত কীর্তির দশম দিনেও বন্ধ হচ্ছে না।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি সচিন। রবিবার মুম্বইয়ে।
“সেই ছোটবেলাতেই আমার কোচ শিখিয়েছিলেন এই খেলাটা ভীষণ নৃশংস। তাই সর্বগ্রাসী বিপদ উপস্থিত হলেও ঘাবড়ে যেও না। পরিশ্রম অক্ষুণ্ণ রেখো। আমি সেই শিক্ষা থেকে সরে যাইনি। আপ্রাণ লড়েছি অথচ দমকা হাওয়ার মতো ভাগ্যের টানে আমার চেষ্টাগুলো বারবার দূরে গিয়ে পড়েছে।” আবেগঘন সচিন বলতে বলতে এ বার জমায়েতকে আরও আশ্চর্য করে দিয়ে জলজ্যান্ত সব উদাহরণ পেশ করা শুরু করলেন, “দিল্লিতে সত্তরের ঘরে এত ভাল ব্যাট করছি। একটা ছোট ভুল আর তাতেই আউট। মুম্বইতে ৯৪ ব্যাটিং। সকাল থেকে নতুন বল সামলে দিয়েছি। দারুণ মানসিকতায় ব্যাট করছি। হঠাৎ একটা বল বেশি লাফাল, বাড়তি সিম করল। কী কপাল বুঝুন। সিডনিতে ৮০ ব্যাটিং। মাইকেল ক্লার্ককে স্টেপ আউট করব ঠিক করেছি। হঠাৎ ও দিক থেকে জোর হাওয়া বইতে শুরু করল। ঠিক করলাম, হাওয়াটা কমলে পরের ওভারে ওকে মারব। অতর্কিতে একটা বল বাড়তি স্পিন করে ব্যাট ছুঁয়ে গেল। কী বলবেন, লম্বা ইনিংসে আউটের আগে তো সাধারণত একটা সতর্কবার্তা আসে। ছোট ওয়েক-আপ কল। অথচ কোনও বার কোথাও কিছু নেই। হঠাৎ পতন ঘটে যাচ্ছে নিমেষে। কী করে জিতবেন ভাগ্যের সঙ্গে এমন অসম লড়াইতে, যেখানে সামান্যতম নিষ্কৃতিও সে আপনাকে দিচ্ছে না।”
তেন্ডুলকরকে মোটেও তখন দেখাচ্ছে না সসাগরা ব্যাটিং সাম্রাজ্যের রূপকথার নায়ক। বরঞ্চ মনে হচ্ছে, সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরের স্কুল ক্যাপ্টেন, যে কোথায় কী বলতে হবে এখনও রপ্ত করেনি। পরিচিত-অপরিচিত নানান মানুষের সামনে নইলে নিজের গহন কোণে জমানো মনোভাব এমন উপুড় করে দেয় নাকি? এমনিতে তাঁকে ছয় লাইনের প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় এক লাইন। মুড ভাল থাকলে দুই। আজ সাংবাদিককুল স্তম্ভিত হয়ে দেখছে, যে মানুষটা ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া টানা দুটো সিরিজে একবারও মুখ খোলেনি, সে আজ এক লাইনের প্রশ্নে উত্তর দিচ্ছে দু’প্যারাগ্রাফ। কখনও দু’প্যারাতেও থামছে না।
পিছনের ফ্লেক্স-এ লেখা, ‘শততম সেঞ্চুরির মহোৎসব’। অথচ কথোপকথনে দেখাচ্ছে অন্য কিছু! ক্রিকেটরাজের চরম অসহায়তা! কীর্তিতে উত্তুঙ্গ হওয়া দূরে থাক, সচিনকে মনে হচ্ছে এলোমেলো অদৃষ্টবাদী। “বাইশ বছর এক রকম গেল। কী আশ্চর্য, জীবন দিয়ে দেখলাম, তেইশতম বছরটা একেবারে অন্য রকম। নতুন করে শিখলাম এই খেলাটার মাহাত্ম্য যে, সব সময় ছাত্রসুলভ মনোভাব নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। অমুক জিনিসটা আমার চাই-ই ভেবে লাভ নেই। কারণ, ওটা নিছক তোমার ওপর ছাড়া নেই। বরঞ্চ স্বপ্ন যদি দেখতেই হয়, অক্লান্ত ধৈর্য দেখানোর জন্য তৈরি থাকো। আর কখনও আশা হারিও না।”
তেন্ডুলকরকে অকপট দেখতে পাওয়া, যেন নিজের ভেতরটা নিজেই স্ক্যান করে দেখছেন। সেটা যদি বিরল অভিজ্ঞতা হয় সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজনের ধরনটাও ছিল ভিন্ন। প্রথমার্ধে মাঝারি সাইজের ঘরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমন্ত্রিত কুড়ি জন সাংবাদিক। সেখানে টিভি ক্যামেরার প্রবেশ নিষিদ্ধ। এ বার সেটা শেষ হওয়ার পর বড় ব্যাঙ্কোয়েট খুলে আম মিডিয়া এবং সচিনের সতেরো স্পনসর। নতুন করে প্রেস কনফারেন্স। উদ্যোক্তা সচিনের যারা ম্যানেজার সেই ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস গ্রুপ। বোঝাই গেল অভিপ্রায় যৌথ। শততম সেঞ্চুরির পর নিজের দেশে প্রথম তাঁকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করানো। আর স্পনসরদের বিশ্বাস জোগানো, চুক্তি দীর্ঘমেয়াদি করা যেতে পারে। সচিন আরও খেলবেন!
সাংবাদিক সম্মেলনে সচিন। রবিবার মুম্বইয়ে।
ঘোষিকা বারবার বলছিলেন, “আনন্দের উৎসব। হ্যাপি প্রশ্ন করুন।” কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের অধুনা এমন সমস্যাবিদীর্ণ, পরাজিত প্রহর চলছে যে, কে শোনে কার কথা! এক জন বেমক্কা জিজ্ঞেস করলেন, ভারতীয় ক্রিকেটের চরম অসম্মানিত সময়ে নিজের ব্যক্তিগত কীর্তি নিয়ে উৎসবপালনে আপনার রুচিতে বাধছে না? সচিন শান্ত গলায় বললেন, “আমরা আজ একটা বছর নিয়েই কেবল আলোচনা করতে বসিনি। আমরা উদ্যাপন করছি দীর্ঘ তেইশ বছরের যাত্রাপথ। এক বছর তার মধ্যে কতটুকু?” মোক্ষম স্ট্রোকে এই ডেলিভারিটা বাকি সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু একটা বাউন্সার যে ক্রমাগত আসতেই থাকল। অবসর সংক্রান্ত।
আচ্ছা আপনি তা হলে কবে অবসর নিচ্ছেন? যত বার প্রশ্নটা উঠল যৎপরোনাস্তি বিরক্তি দেখালেন সচিন।
এই অবসর-অবসর নিয়ে ঠেস দেওয়ায় প্রাক্তন দুই টিমমেটের ওপর এখন মারাত্মক খেপে রয়েছেন তিনি। মুম্বইয়ের প্রাক্তন তিন নম্বর ব্যাটসম্যান লিখেছেন, ভারতীয় ড্রেসিংরুমে সচিনের উপস্থিতি এখন বয়স্ক হাতির মতন। আর কিংবদন্তি প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক টিভি-তে বলেছেন, “ধুর, কবে ওর খেলা ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। ফালতু পড়ে আছে!” এ দিন দেখে মনে হল হিটলিস্টে এই দু’জন থেকে গেলেন। কারণ অবসর নিয়ে জিজ্ঞাসা এই মুহূর্তে তাঁর সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গ।
মিডিয়ার সামনে প্রকাশ্যে আবির্ভূত সচিনের মুখের আজ নানা রং। কখনও বিনম্র। কখনও দার্শনিক। কখনও ক্ষুব্ধ। কখনও রাগে গরগরে। কখনও ক্রিকেট নেশাড়ু। এই রাগে গরগরে অংশটা প্রতিবার বেরোল, যখন-যখন অবসর নিয়ে প্রশ্ন হল। সচিন সাফ বলে দিলেন, “যাঁরা প্রশ্নটা করছেন তাঁদের সাহায্যে যখন আমি এই পেশাটায় ঢুকিনি, তখন আমি কখন ছাড়ব তার সুপারিশ করারও ওঁরা কেউ নন।” সচিনের উত্তেজিত যুক্তি, পেশাদার তার পেশায় থাকবে কি থাকবে না সেটা তো সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। অন্য পেশার একটা লোক কী করে তা নিয়ে ক্যাম্পেন করতে পারে? হ্যাঁ, কেউ বলতে পারে সচিনের যা খেলার ছিরি ওকে আর টিমে নেওয়া উচিত নয়। কিন্তু সচিন কী করবে সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞ বলার কে? ঊনচল্লিশ বছর থেকে মাত্র এক মাস দূরে থাকা ব্যক্তির মনোভাব দেখে মনে হল, আরও অন্তত এক বছর ধরেই রাখা যায় স্থায়ী হবে তাঁর ক্রিকেটজীবন।
সমালোচকদের নিয়ে বলতে বলতে এক এক সময় তাঁর গলায় উঠে আসছে তীক্ষ্ম ব্যঙ্গ। বললেন, “টিভির সামনে বসে থাকা কিছু বিশেষজ্ঞ যারা আমার শরীর কী অবস্থায় জানে না, মন কী অবস্থায় জানে না, যারা মাঠে হাওয়া কোন দিকে বইছে জানে না, তারা অনায়াসে মন্তব্য করে দিচ্ছে আমার কী করা উচিত। জীবনে যে একটাও সেঞ্চুরি করেনি, সে উপদেশ দিচ্ছে কী করে আমি নিজের শততমটা পেতে পারি।” শুনতে শুনতে হাসিতে ফেটে পড়ে সমাবেশ। এ বার সচিন নিজেও হেসে ফেললেন।
হ্যামিল্টন ব্ল্যান্ড নামক এক ইংরেজ স্মারক সংগ্রাহক এ দিনের অনুষ্ঠানে নতুন আঙ্গিক যোগ করলেন। ইনি স্পোর্টস মেমোরেবিলিয়া বিশেষজ্ঞ, যদিও একদা ছিলেন নামী ব্রিটিশ সাঁতারু আর মার্ক স্পিৎজের ম্যানেজার। স্পিৎজ, মেসি, রোনাল্ডো এঁদের বিশেষ স্মৃতিবিজড়িত সরঞ্জাম নিয়ে অতীত বাণিজ্যের পর এ বার হ্যামিল্টন আকৃষ্ট সচিনে। প্রথম ভারতীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে আজ থেকে সচিনের স্মৃতিবিজড়িত এবং সই করা ব্যাট-গ্লাভস জাতীয় সরঞ্জাম বিশেষ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি শুরু হল। দাম আম ক্রিকেটপ্রেমীর ছোঁয়ার বাইরে। সবচেয়ে কম দামি স্মারকের দাম আশি হাজার টাকা। কিন্তু হ্যামিল্টন শুনতে রাজি নন। বলছেন, “শততম সেঞ্চুরি পেলের হাজার গোল বা স্পিৎজের সাতটা সোনা জেতার মতো। কিঞ্চিৎ মহার্ঘ তো হবেই!”
কথা বলতে বলতে এক ফাঁকে সচিন বলে উঠলেন, “আমার রেকর্ড যদি কখনও কেউ ভাঙে সে যেন ভারতীয় হয়।” ঘরসুদ্ধু তুমুল হাততালি। কে বলবে প্রেস কনফারেন্সে হাততালির রেওয়াজ নেই। রোববার অবশ্য এমনই বিরল সাংবাদিক সম্মেলন ছিল যে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট উদ্ধৃত মুখে মুখে ঘোরা দিনের রসিকতাকেই সত্যি মনে হচ্ছিল। যা বলছে, পাকেচক্রে ইউপিএ সরকারের কঠিন বোঝা সামলে দিচ্ছেন সচিন। প্রণববাবুর তথাকথিত হতাশাজনক বাজেট ভুলিয়ে দিয়েছিলেন সে দিনই শততম সেঞ্চুরি করে। আর আজ অণ্ণা হজারের যন্তরমন্তর পর্বকে ম্লান করে দিল তাঁর জমকালো মিডিয়া মিট।
সচিনের নিজের মনে হল না এ সব প্রসঙ্গে কোনও ইন্টারেস্ট আছে বলে। যাওয়ার আগে একমুখ হাসি তাঁর মুখে, “যাক বাবা আর কেউ বলছে না তোমার জন্য প্রার্থনা করছি। আমার কানগুলো এখন থেকে আরামে থাকবে!”
শততম সেঞ্চুরির প্রতীক্ষা কী দুর্বিষহ, কী পরিমাণ নরকযন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্যাটিং চ্যাম্পিয়ন হয়েও, তার যথেষ্ট নমুনা রবিবারের মুম্বই পেশ করে গেল। পিছনের ফ্লেক্সটায় মনে হচ্ছিল শততম সেঞ্চুরির উৎসব লেখার চেয়ে অনেক উপযুক্ত কোনও লাইনের খোঁজ পাওয়া যেত।
‘ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা থেকে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন উৎসব’।

ছবি: এ এফ পি




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.