লোকপাল বিল লইয়া আবার তৎপরতা শুরু হইয়াছে। এই বিলটির প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির প্রধান মতপার্থক্য যে প্রশ্নে, তাহা হইল এই বিলের মধ্যে রাজ্য স্তরের লোকায়ুক্তকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভায় বিরোধীরা তো বটেই, এমনকী সরকারের শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং সমর্থক দল সপা ও বসপা-র আপত্তিতে ওই অন্তর্ভুক্তি অনুমোদিত হয় নাই। এ বার তাই বিলটি পুনরালোচনার জন্য গ্রহণ করার আগে সরকার সতর্ক। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় বৈঠকও হইয়া গেল। বৈঠকে লোকায়ুক্ত নিয়োগের বিষয়টি বিলের আওতার বাহিরে রাখার প্রস্তাব উঠিয়াছে। কংগ্রেস এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স ছাড়া আর সব দলই এই প্রশ্নে দৃঢ় অভিমত জানাইয়াছে।
কারণটি সহজবোধ্য। লোকায়ুক্ত রাজ্য স্তরে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মঞ্চ। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত লওয়ার অধিকারী তাই একান্ত ভাবেই রাজ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে কোনও অভিমত বা অভিপ্রায়, কিছুই থাকিতে পারে না। রাজ্যের সরকারগুলিও কেন্দ্রীয় সরকারের মতোই নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত। কেন্দ্রীয় সরকারের যতটা সাংবিধানিক বৈধতা আছে, রাজ্য সরকারগুলিরও ততটাই। তাই কেন্দ্র রাজ্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনও বিষয়ে একতরফা ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত বা বন্দোবস্ত চাপাইয়া দিতে পারে না, বড় জোর রাজ্যকে পরামর্শ দিতে পারে। যে-পরামর্শ মানিতে রাজ্যগুলি আদৌ বাধ্য নয়। লোকায়ুক্ত নিয়োগ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় আইনে প্রাদেশিক দলগুলির আপত্তির মূল কারণ এখানেই। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করিয়া কেন্দ্রের হাতে অধিকতর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতাটি স্বাধীনতার পর হইতেই পরিলক্ষিত হইতেছে। কংগ্রেস স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতির প্রতিনিধিত্ব করিয়াছিল বলিয়া জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার অধিকার একাই আত্মসাৎ করিতে চাহিয়াছে। যত দিন কেন্দ্রে ও অধিকাংশ রাজ্যে কংগ্রেস দলের সরকার কায়েম ছিল, তত দিন এ ব্যাপারে বিশেষ বাধা আসে নাই। সেই সুযোগে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার সংবিধানে রাজ্য-তালিকার অন্তর্ভুক্ত নানা বিষয়কে যৌথ তালিকায় টানিয়া আনিয়াছে, নানা সংশোধনী মারফত রাজ্যের এক্তিয়ার ও অধিকারকে সঙ্কুচিত করিয়াছে। কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করিয়া সেখানে নয়াদিল্লির আধিপত্য স্থাপনও এই প্রক্রিয়াতেই সংঘটিত তথা সংগঠিত হয়। কিন্তু ক্রমে জাতীয় দল হিসাবে কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়, রাজ্যে-রাজ্যে আত্মপরিচয়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়া আঞ্চলিক ও প্রাদেশিক দলগুলির জন্ম ও বিকাশ এবং রাজ্যের রাজনৈতিক এক্তিয়ার ও আর্থিক তহবিলের জন্য তাহাদের দরকষাকষি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিস্মৃত ও খণ্ডিত সাংবিধানিক নীতিটিকে নূতন করিয়া পাদপ্রদীপের আলোয় আনিয়া ফেলে। আজ বিভিন্ন রাজ্যের সরকার ও দলগুলি কেন্দ্রীয় শাসক দলকে ফাঁকা মাঠে গোল করিতে দিতে রাজি নয়। লোকায়ুক্ত প্রশ্নে তাই ইউপিএ সরকারকে পিছু হটিতেই হইবে। অন্যথায় লোকপাল বিল পাশ করানো দুঃসাধ্য। |