অমিত মিত্র দীনেশ ত্রিবেদীর মতো ভুল করেন নাই। ফলে, তাঁহার বাজেটটি একাধারে বিতর্কহীন ও বিশেষত্বহীন। এই বাজেটে ঘাটতি হ্রাস করিবার যে প্রস্তাব রহিয়াছে, কেন্দ্রীয় অনুদানের উপর যতখানি নির্ভরশীলতা রহিয়াছে, সেইগুলি লইয়া প্রশ্ন তোলা যায়, কিন্তু আপাতত সে প্রসঙ্গ থাকুক। উন্নয়ন বলিতে সরকার কী বোঝে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাইতে সরকার কোন পথে হাঁটিবে এই প্রশ্নগুলির উত্তর নূতন সরকারের প্রথম বাজেটে প্রত্যাশিত। গত বৎসর অমিত মিত্র পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। সরকারের বয়স দশ মাস হইবার পর প্রথম বাজেটটি পাওয়া গেল। তাহাতে নূতন দিশা নাই। তবে, নূতন স্লোগান রহিয়াছে ‘কৃষক আমাদের গৌরব, কৃষি আমাদের সম্পদ’। বোঝা গেল, সি পি আই এম-এর ভূত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়ে নাই আগের সরকারের বহুচর্চিত স্লোগানের অক্ষরবৃত্ত ছন্দটিও তিনি বজায় রাখিয়াছেন।
কিন্তু, কৃষি নামক ‘সম্পদ’টি লইয়া রাজ্য কী করিবে? কৃষি জিনিসটি বেশ গোলমেলে। গোলমালের উৎস একাধিক। প্রথম কথা, পশ্চিমবঙ্গে কৃষিজমির পরিমাণ যত, কৃষির উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা তাহার অনুপাতে বিপুল। ফলে, অর্থনীতির পরিভাষায় যাহাকে ‘প্রচ্ছন্ন কর্মসংস্থানহীনতা’ বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে সেই সমস্যা ইতিমধ্যেই ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়াছে। দ্বিতীয় সমস্যার নাম জল। বামফ্রন্ট সরকার গত শতকের আশির দশকে নিজস্ব ‘সবুজ বিপ্লব’-এর মোহে পড়িয়া যথেচ্ছ ক্ষুদ্র সেচে প্রশ্রয় দিয়াছিল। যে সংকর বীজের সর্বগ্রাসী তৃষ্ণা মিটাইতে অগভীর নলকূপের মাধ্যমে নির্দ্বিধায় ভূগর্ভস্থ জল তুলিয়া লওয়া হইয়াছে। এখন সেই পাম্প সেটেই গরল উঠিতেছে। তাহার নাম আর্সেনিক। পশ্চিমবঙ্গ বিশ্বের আর্সেনিক-রাজধানী। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার না করিয়া যদি পূর্বের পদ্ধতিটিই বজায় রাখা হয়, এই গরলেই পশ্চিমবঙ্গের পূর্ণগ্রাস হইবে। তৃতীয় সমস্যা কৃষির উৎপাদনশীলতা। সংস্কার হইলে, গবেষণা-খাতে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করা হইলে পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতা কিছু বাড়িতে পারে বটে, কিন্তু তাহা রাজ্যের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হইয়া উঠিতে পারে না। হইলে, পশ্চিমবঙ্গের অধোগতি অপ্রতিরোধ্য হইবে। চতুর্থ সমস্যা হইল, অর্থনীতির গবেষণায় বার বার প্রমাণিত হইয়াছে, যে রাজ্য বা দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি কৃষি, তাহার লাভযোগ্যতা কম। কেন, সেই তত্ত্বটি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী জানেন বলিয়াই অনুমান করা চলে।
অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎটি কৃষির হাতে ছাড়িয়া দিলে বিপদ। নিস্তারের পথ একটিই শিল্পের আবাহন। বামফ্রন্ট সরকার তাহার শেষ পর্বে এই কথাটি বুঝিয়াছিল। ফলে, তাহাদের স্লোগানে অন্তত শিল্পের উল্লেখ ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই স্লোগানের ছন্দটি গ্রহণ করিলেও শিল্পের প্রসঙ্গটি সযত্নে পরিহার করিয়াছেন সম্ভবত তাহাতে বামফ্রন্টের গন্ধ লাগিয়া আছে বলিয়াই। বর্তমান বাজেটে শিল্পের প্রতি ঔদাসীন্য প্রকট। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প আনিতে রাজ্য সরকারের যে কিছুমাত্র উৎসাহ আছে, তাহা এই বাজেট দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই। বিপরীতে, শিল্পের গতিরোধ হইতে পারে, এমন একটি প্রস্তাব বিলক্ষণ উপস্থিত। তাহার নাম ‘প্রবেশ কর’। এই করটি মূল্যস্ফীতি বাড়াইবে, ফলে ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সমস্যা বাড়িবে। এহ বাহ্য। এই করটি প্রকৃতার্থে দুর্নীতির সিংহদরজা। শিল্পমহল স্বভাবতই আপত্তি জানাইয়াছে। অন্য দিকে, এই করটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোরও পরিপন্থী। ভারত একটিই দেশ, তাহার বাজারও অভিন্ন। অন্য রাজ্যের পণ্য এই রাজ্যে আনিতে হইলে যদি কর দিতে হয়, তাহা এই বাজারের চরিত্রের পরিপন্থী। বামফ্রন্ট সরকার এক সময় এই করটি পরিহার করিয়াছিল, হয়তো করটির চারিত্রিক ত্রুটি অনুধাবন করিয়াই। বামপন্থীরা যাহা ফেলিয়া দেন, তাহাকেই কুড়াইয়া লইবার প্রবণতাটি বিপজ্জনক। বামপন্থীদের ফেলিয়া-দেওয়া বা ফেলিতে-চাওয়া বামপন্থার উত্তরাধিকারটিকে সযত্নে বহন করিবার অভ্যাসের মতোই বিপজ্জনক। |