বেনজির উষ্ণায়ন বা লাগামছাড়া তুষারপাত। বিশ্ব জুড়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। আর তার জেরে এ বার ছন্দপতন ঘটছে কালবৈশাখীরও!
আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় বাংলার ঋতুচক্রে পরিবর্তন ঘটছে বেশ কিছু কাল ধরেই। বর্ষা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। হেমন্ত বলে যে একটা ঋতু আছে, কয়েক বছর ধরে সেটা প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। বর্ষা শেষ হতে না-হতেই চলে আসছে শীত। নিজের সময়গণ্ডি পেরিয়ে শীত গ্রাস করেছে বসন্তকে। সব মিলিয়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বায়ুপ্রবাহের ধরনটাই।
সেই বিশ্ঙ্খলার কবলে পড়েছে কালবৈশাখীও। আবহবিদেরা বলছেন, সাধারণ ভাবে নির্দিষ্ট ছন্দ মেনে মার্চে অন্তত দু’টো কালবৈশাখী হয়। এপ্রিলে গোটা চারেক। আর মে মাসে পাঁচ-ছ’টা। কিন্তু এই ছন্দটাই গত সাত-আট বছরে হারিয়ে গিয়েছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯, ২০১০ সালের মার্চে একটাও কালবৈশাখী হয়নি বাংলায়। এপ্রিলে নাম-কা-ওয়াস্তে দু’তিনটে করে কালবৈশাখী হয়েছে। সেগুলো ছিল নিতান্তই দুর্বল। গত বছরের ৩০ মার্চ খুব দুর্বল একটা কালবৈশাখী বয়ে গিয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়ে। এপ্রিলে হয়েছিল একটি। মে-তে ১৩টি। সব মিলিয়ে কালবৈশাখী তার ‘কোটা’ পূরণ করলেও ছন্দটাই পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল।
এ বারেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে বলে আশঙ্কা করছে হাওয়া অফিস। চলতি মার্চে এখনও পর্যন্ত কালবৈশাখীর দেখা মেলেনি। পরিবর্তনের ধাক্কায় বায়ুপ্রবাহের প্রকৃতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে মার্চের বাকি সময়টাতেও কালবৈশাখী হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে আবহবিদদের।
কালবৈশাখীর আচরণে এমন বিশৃঙ্খলা, এমন তালভঙ্গ কেন? |
আবহবিদদের মতে, যেটাকে ছন্দপতন বলে মনে হচ্ছে, সেটা হয়তো ছন্দবদল। আসলে কালবৈশাখীর চরিত্রেই যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ।
কেমন পরিবর্তন?
গোকুলবাবু বলছেন, “আকাশ ঘোর কালো হয়ে উঠবে। তার পরে উঠবে প্রবল ঝড়। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাবে। প্রচণ্ড শব্দে পড়বে বাজ। শেষে প্রবল বর্ষণ। এটাই কালবৈশাখীর চরিত্র। কিন্তু ইদানীং কালবৈশাখীতে আর তেমন তীব্র ঝড় ওঠে না। ফলে বৃষ্টিও আশানুরূপ হয় না। ঠিক এই মুহূর্তে যে-বৃষ্টিটা দরকার, তা পাওয়া যায় না। যাচ্ছেও না।”
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৩ সালে কালবৈশাখী ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২৪ কিলোমিটার। ’৭৮ সালে প্রতি ঘণ্টায় ১৫৩ কিলোমিটার গতিবেগের কালবৈশাখী দেখেছে কলকাতা। ২০০০ সাল পর্যন্ত ওই ঝড়ের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তার গতিবেগ অত্যন্ত কমে গিয়েছে। ২০০৯ সালে কালবৈশাখীর সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ৮২ কিমি, ২০১০ সালে ৭২ কিমি এবং গত বছর ৭৫ কিমি।
গোকুলবাবুর আক্ষেপ, “গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, মেঘ জমছে, বাজও পড়ছে। কিন্তু যার জন্য নামটা কালবৈশাখী, সেই প্রচণ্ড ঝড়টাই নেই। আসলে কৌলীন্যটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে কালবৈশাখী। আপাতদৃষ্টিতে এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়তো কমেছে। কিন্তু আবহাওয়ার স্বাভাবিক ছন্দটাই যে আর থাকছে না!”
তালভঙ্গটা স্পষ্ট। কিন্তু কালবৈশাখী এ ভাবে ছন্দ হারাল কেন?
উত্তর দিতে গিয়ে কালবৈশাখীর সৃষ্টিতত্ত্ব শোনাচ্ছেন আবহবিদেরা। তাঁরা বলছেন, এই সময়ে ঝাড়খণ্ড এবং সন্নিহিত এলাকায় দিনের তাপমাত্রা যত বাড়ে, ততই মাটি থেকে অতিরিক্ত তাপ বিকিরণের জন্য বাতাস গরম হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। সেই গরম বাতাস বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে এসে তৈরি করে উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ। সেই মেঘপুঞ্জ ঝাড়খণ্ড থেকে সরে আসে দক্ষিণবঙ্গের দিকে। জলীয় বাষ্প বেশি হয়ে গেলে সেই উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ ভেঙে যায়। আর তাতেই কালবৈশাখী তৈরি হয়। অর্থাৎ কালবৈশাখীর জন্য প্রয়োজন ঝাড়খণ্ড এবং সন্নিহিত এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। প্রয়োজন বঙ্গোপসাগরে উচ্চচাপ বলয়, যা জলীয় বাষ্পকে দখিনা বাতাসের হাত ধরে পৌঁছে দেবে ঝাড়খণ্ডের উপরে। এগুলো ঠিকঠাক চললে তবেই তৈরি হয় উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ। ঝাড়খণ্ড এবং সন্নিহিত দক্ষিণবঙ্গে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েই রয়েছে। রবিবারেও কলকাতায় তা ছিল এই সময়ের স্বাভাবিকের থেকে দু’ডিগ্রি বেশি (৩৭.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। কিন্তু উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ তৈরির জন্য জলীয় বাষ্পের ঝাড়খণ্ডে পৌঁছনোর দরকার। সেটাই পৌঁছচ্ছে না।
জলীয় বাষ্প পৌঁছচ্ছে না কেন?
আবহবিদেরা দোষ দিচ্ছেন উত্তর ভারতের পশ্চিমী ঝঞ্ঝার বাড়াবাড়িকে। গোকুলবাবু বলছেন, “মার্চের এই চতুর্থ সপ্তাহেও উত্তর ভারতে অতি শক্তিশালী একটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা রয়েছে। তার প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে উচ্চচাপ বলয় তৈরি হতে পারছে না। এর ফলে গতি পাচ্ছে না দখিনা বাতাস। ফলে যেটুকু জলীয় বাষ্প ঢুকছে, তা-ও ঝাড়খণ্ডে গিয়ে পৌঁছতে পারছে না।”
বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। ঝড়বৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তের লাগোয়া কয়েকটি অঞ্চলে। অসম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে, এমনকী উত্তরবঙ্গেরও কোথাও কোথাও ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কলকাতা এবং সন্নিহিত এলাকায় আকাশে মাঝেমধ্যে মেঘ ঢুকে পরিস্থিতি গুমোট করে দিচ্ছে মাত্র। বৃষ্টি হচ্ছে না।
কলকাতা বা ঝাড়খণ্ডের সংলগ্ন এলাকায় ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে না কেন?
আবহবিদদের ব্যাখ্যা, দখিনা বাতাসে জোর না-থাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে ঢোকা জলীয় বাষ্প উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলে যাচ্ছে বলেই এখানে এই বৃষ্টিহীন পরিস্থিতি চলছে। ওই জলীয় বাষ্প থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মেঘপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে। তা থেকে বৃষ্টিও হচ্ছে। তবে তা সাধারণ ঝড়বৃষ্টি। কালবৈশাখী নয়।
এই পরিবর্তনে আবহবিদেরা বিশ্বপ্রকৃতির হাওয়া-বদলের হাতও দেখছেন। গোকুলবাবু বলছেন, ইউরোপের আবহাওয়া এখন সরাসরি প্রভাবিত করছে ভারতীয় উপমহাদেশের আবহাওয়াকে। তার জেরেই সব বদলে যেতে বসেছে। কী ভাবে?
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, ভূমধ্যসাগরীয় নিম্নচাপ তৈরি করছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে কাশ্মীর দিয়ে তা ঢুকছে এ দেশে। সেই ঝঞ্ঝাই সব গোলমাল করে দিচ্ছে। উত্তর ভারতে শীত দীর্ঘায়িত হয়েছে। উত্তুরে হাওয়ার দাপাদাপি থাকছে অনেক দিন। যে-কালবৈশাখী দক্ষিণবঙ্গের ‘নিজস্ব’ সম্পদ, তাকেও কক্ষচ্যুত করে দিচ্ছে ওই ঝঞ্ঝা।
তা হলে কালবৈশাখী কি আর ছন্দে ফিরবে না?
আবহবিদেরা বলছেন, যত তাড়াতাড়ি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা দুর্বল হয়, সামগ্রিক ভাবে আবহাওয়াও তত দ্রুত স্বাভাবি এবং তখন স্বাভাবিক নিয়মে কালবৈশাখীর সম্ভাবনাও বাড়বে। |