|
|
|
|
‘অভিমুখ’ গ্রাম, কিন্তু প্রশ্ন উঠল পথ নিয়েই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে মূলত গ্রামীণ ক্ষেত্রের উপরে জোর দিয়ে নতুন রাজ্য সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করা হল। কিন্তু তা করতে গিয়ে সড়ক নির্মাণ থেকে শুরু করে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সব ব্যাপারেই মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পগুলির উপরেই নির্ভর করলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মূল স্লোগান ‘মা-মাটি-মানুষ’ গ্রামকে ভিত্তি করেই। এ রাজ্যের সিংহভাগ লোকসভা ও বিধানসভা আসন তৃণমূলের দখলে থাকলেও সরকারি ভাবে তাদের দখলে মাত্র দু’টি জেলা পরিষদ। স্বাভাবিক ভাবেই অদূর ভবিষ্যতে অধিকাংশ জেলা পরিষদ দখলের লক্ষ্যে গ্রামের মানুষকে ‘খুশি’ করতে চাওয়া হয়েছে বাজেটে। যা থেকে স্পষ্ট, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের আগে এক বছর ধরে এই বাজেটের ‘সুফল’ গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় সরকার।
তবে অমিতবাবুর বাজেট সম্পর্কে তাঁর একাধিক সতীর্থ মন্ত্রীই জানাচ্ছেন, পঞ্চায়েতের উপর স্পষ্ট ‘জোর’ দেওয়া হয়নি। আলাদা করে পঞ্চায়েত দফতরেরও উল্লেখ বাজেটে নেই। তাঁদের কথায়, “যে সমস্ত প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে, সেগুলি তো কেন্দ্রীয় সরকারেরই প্রকল্প! রাজ্য সরকার নিজে কী করবে, তার কোনও রূপরেখা তো বাজেটে নেই!”
একই কারণে বাজেটের সমালোচনা করেছে সরকারের জোট শরিক কংগ্রেস। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যে উন্নয়নের কাজ হয়। সেই প্রকল্পের সুযোগ গ্রহণ করলেও প্রকল্পগুলি যে আদতে কেন্দ্রের, তা বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি। বিরোধী বামফ্রন্টেরও প্রশ্ন, যে সরকার গরিব মানুষের কথা বলে, তাদের বাজেটে পঞ্চায়েত বা ভূমি দফতরের আলাদা উল্লেখ নেই কেন? বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “গত বছরের চেয়ে এ বার পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়নে বরাদ্দ কমে গিয়েছে প্রায় দু’শো কোটি টাকা। নগরোন্নয়নেও বরাদ্দ কমেছে। বেশির ভাগ গরিব মানুষই তো এই সব দফতরের আওতায় পড়েন। ‘বাজেট এক নজরে’ পুস্তিকাটি দেখলেই বোঝা যাবে, সরকার কী করেছে!” সূর্যবাবুর আরও দাবি, গ্রামীণ কর্মসংস্থান বা কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের যে হিসেব পেশ করা হয়েছে, তা ‘অসত্য’।
তৃণমূল শিবিরের অবশ্য বক্তব্য, বাজেট যে পঞ্চায়েত ভোটের দিকে তাকিয়ে, তা ‘চোখে আঙুল’ দিয়ে দেখানোর দরকার পড়ে না। গ্রামোন্নয়ন দফতরের কথা বলা হয়েছে। সেই মোড়কেই রয়েছে পঞ্চায়েতের কথা। তাদের আরও অভিমত, দফাওয়াড়ি বাজেট দেখে তবেই এক একটি দফতর সম্পর্কে পৃথক মতামত দেওয়া সম্ভব। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
বাজেটে নতুন ঘোষণা তেমন কিছু নেই। রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের প্রতিটিতে ‘কৃষিরত্ন’, কিষাণ মান্ডি, হিমঘর বা ‘কোল্ড চেনে’র কথা আগেই মুখ্যমন্ত্রী কোনও না কোনও সময় ঘোষণা করেছেন। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কৃষি দফতরের বরাদ্দ তিনি প্রায় ১৮% বাড়িয়েছেন। আর কৃষি বিপণন দফতরের বাজেট ৩১৮%-এরও বেশি বাড়িয়ে ১৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
কৃষিতে জোর দিতে গিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই তুলনায় কম ‘গুরুত্ব’ দেওয়া হয়েছে শিল্পকে। শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ বা তথ্যপ্রযুক্তি ও বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের কথা বলা হলেও নতুন কোনও ‘দিশা’ দেখানো হয়নি। বরং বাজেটের পরে অর্থমন্ত্রী অমিতবাবুকে পাশে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে পঞ্চায়েত দফতরের দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকেই রাজ্যে ১০০ দিনের কাজে গতি আনার চেষ্টা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থানই তাঁর সরকারের প্রধান
লক্ষ্য। বাজেটেও বলা হয়েছে, গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের অধীনে শ্রমদিবস বছরে ১০০ দিন ছাড়িয়ে গেলে পরিবার পিছু সর্বোচ্চ ২০০ দিনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করবে সরকার। বলা হয়েছে, এই অর্থবর্ষে ১০০০-এর বেশি জনসংখ্যার ২০০টি গ্রাম ও ৫০০-র বেশি জনসংখ্যার ৪০টি গ্রামে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ জন্য প্রায় ৭৩১ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হবে। যে গ্রামগুলির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ নেই, সেগুলির সঙ্গে আগামী দু’বছরে (২০১৪-র মধ্যে) যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
বাজেট নিয়ে তাঁদের ‘অসন্তুষ্টি’ গোপন করেননি কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “আগামী বছরের উন্নয়নের স্পষ্ট দিশা পাওয়া যায়নি বাজেটে।” কংগ্রেস পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবেরও বক্তব্য, “বাজেটে যে প্রকল্পগুলির কথা বলা হয়েছে, তার বেশির ভাগটাই কেন্দ্রীয় প্রকল্প। কেন্দ্রীয় টাকাকেই এই বাজেটে নিজেদের টাকা বলে দাবি করা হয়েছে!”
পঞ্চায়েত, তথ্য-সংস্কৃতি, পুলিশের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের (যার মধ্যে অনেকগুলিই খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে) উল্লেখ বাজেটে নেই বলেও অভিযোগ কংগ্রেসের।
সোহরাবের বক্তব্য, “জনমুখী বহু নতুন প্রকল্পের কথা রয়েছে। কিন্তু সে সব রূপায়ণের টাকা কোথা থেকে আসবে, তার ব্যাখ্যা বাজেটে নেই। আয়ের থেকে ব্যয়ের কথাই তো বেশি! বাজেটের বাস্তবায়ন কী ভাবে হবে, সেটাই মূল চিন্তা।”
বিরোধী দলনেতার মতে, “বাজেটে কতগুলো অবাস্তব দাবি করা হয়েছে। অসম্ভব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অনেক তথ্যে অসঙ্গতি ও অনেক ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা আছে। দিশা দেখানোতেও অসম্পূর্ণতা রয়েছে।” সূর্যবাবুর আরও বক্তব্য, “পরিকল্পনা খাতে যে বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষিতে ধরলে তা কার্যত শূন্যে দাঁড়াবে! তাই দাবিগুলো ভিত্তিহীন!”
কংগ্রেস নেতৃত্বের সমালোচনার মূল বক্তব্য বাজেট যে ধরনের ‘তথ্যভিত্তিক’ হওয়া উচিত, তা হয়নি। বহু ‘বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা’ রয়েছে। শিল্প থেকে গ্রামোন্নয়ন, এমনকী সংখ্যালঘু উন্নয়নের প্রসঙ্গেও ‘বিভ্রান্তি’ রয়েছে। প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আন্দোলনের সময় আমরা বলতাম, রাজ্যে শিল্পের পরিকাঠামো তৈরি নেই। তা করা দরকার। বাজেটে কিন্তু সেই পরিকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে আমাদের সরকার কী ভাবছে, তা স্পষ্ট হয়নি। পরিকাঠামোয় কত টাকা বরাদ্দ হবে, তারও কোনও উল্লেখ নেই। শিল্প কী ভাবে আসবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসারে সরকার কী করবে, তা নিয়েও পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি।”
বাজেটে কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাঙ্ক তৈরির প্রস্তাব নিয়ে প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “কোন ক্ষেত্রে চাকরি দেওয়া হবে, তা বলা হয়নি। অর্থমন্ত্রী কর্মসংস্থান প্রকল্প সুনিশ্চিত ভাবে ঘোষণা করলে খুশি হতাম।” কংগ্রেস মুখপাত্র আব্দুল মান্নান বলেন, “সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। তাদের কর্মস্থানের কথা বলা হলেও সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।”
সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা চাপানো না-হলেও ভিন্ রাজ্যের পণ্যবাহী যান প্রবেশে কর আরোপ করায় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে বলে কংগ্রেস নেতাদের আশঙ্কা। প্রদীপবাবুর মতে, “কেন্দ্রীয় সরকার বাজেটের আগে যেমন সর্বদল বৈঠক করে বা শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের
সঙ্গে আলোচনা করে, তেমনই মুখ্যমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রী আমাদের সুপারিশ জানতে চাইলে এখনও আমরা মতামত জানিয়ে তাঁদের সহযোগিতা করতে পারি।” |
|
|
 |
|
|