কৃষি-ক্ষুদ্রশিল্পে জোর, কর বৃদ্ধি বিলাসপণ্যে
ত বাজেটে আশা করেছিলেন রাজস্ব ঘাটতি হবে ৮ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। বছরের শেষ লগ্নে এসে দেখা যাচ্ছে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। তার পরেও শুক্রবার ২০১২-১৩ আর্থিক বছরের বাজেট পেশ করতে গিয়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৬ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকায় বেঁধে রাখার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। যদিও সেই আত্মবিশ্বাসের উৎস সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা অনেকেই সন্দিহান।
রাজস্ব ঘাটতিকে নিজস্ব সীমায় বেঁধে রাখার উপায় দু’টি। প্রথমত, রাজস্ব আদায় বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, খরচ কমানো। অমিতবাবুর আশা ছিল, চলতি অর্থবর্ষে রাজস্ব আদায় ৩০ শতাংশ বাড়বে। বাস্তবে হয়েছে ২৫ শতাংশের মতো। নতুন অর্থবর্ষেও রাজস্ব আদায় কী ভাবে বাড়বে, তার দিশা অমিতবাবুর এ দিনের বাজেট বক্তৃতায় নেই বলে অর্থনীতিবিদদের পশাপাশি রাজনীতিকদেরও একাংশের অভিমত। পাশাপাশি, চলতি আর্থিক বছরে সরকারি খরচে লাগাম টানতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। আগামী বছরেও যে পারবেন, তার কোনও পথনির্দেশ বাজেটে নেই। ফলে বাজেট বক্তৃতায় আশার ছবি আঁকলেও বছর শেষে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মেনে তাঁর বাজেটে সাধারণ মানুষের উপরে করের বোঝা বিশেষ চাপাননি অমিতবাবু। নজর দিয়েছেন কয়েকটি বিলাস পণ্যে। যা দেখে খুশি মুখ্যমন্ত্রী বাজেট পেশের পরে অমিতবাবুকে পাশে নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “মানুষের উপর কোনও করের বোঝা না-চাপিয়ে একটি স্থিতিশীল বাজেট পেশ করা হয়েছে। যাঁরা দশ লক্ষ টাকার বেশি দাম দিয়ে গাড়ি কিনতে পারেন, তাঁরা এই করটুকুও দিতে পারবেন।”
বাজেট-বক্তৃতার এক মুহূর্তে অর্থমন্ত্রী। পিছনে মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, বিলাসপণ্য যে হেতু বেশি বিক্রি হয় না, সে হেতু এখানে কর বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। সরকারের আয় বাড়াতে গেলে সেই সব জিনিসের উপরেই নজর দিতে হবে, যা বিক্রি হয় বেশি। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবেন এবং মমতাও, সেই আশঙ্কায় ওই সব জিনিসের গায়ে হাত দেননি অমিতবাবু। যদিও বাম আমলে তুলে দেওয়া প্রবেশ কর ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ঘুরপথে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেবে বলেই অনেকের আশঙ্কা। প্রবেশ কর সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের প্রথম আপত্তি, এতে দুর্নীতি (ঘুষ দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার প্রবণতা) বাড়ে। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব আয় যা হয়, তার তুলনায় পরিকাঠামো ব্যয় বেশি। তার উপর একই জিনিসের উপরে একাধিক স্তরে কর আরোপ তুলে দেওয়ার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে, এটা তার পরিপন্থী। মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্য ব্যাখ্যা, অনেক রাজ্যেই এই কর রয়েছে।
রাজস্ব বাড়াতে অর্থমন্ত্রীর তৃতীয় দাওয়াই, কর ব্যবস্থার সরলীকরণ ও বৈদ্যুতিন ব্যবস্থা (ই গভর্নেন্স) চালু করা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। সেটা কতটা কার্যকরী হয়, তা-ই এখন দেখার।
বাজেট একনজরে
সরকারের শরিক দল কংগ্রেস অবশ্য বাজেট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে সহমত নয়। কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব বলেন, “উন্নয়নের টাকা কোথা থেকে আসবে তা জানা নেই।” আর রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, অর্থমন্ত্রী অবাস্তব কিছু দাবি করেছেন। এই বাজেটের দিশা একটাই। ৩৪ বছরে বাম জমানায় কিছু হয়নি, তা বোঝানো।
এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, চলতি আর্থিক বছরে কেন প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হল না? অমিতবাবুর ব্যাখ্যা, কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি ৯ শতাংশ হবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু হয়েছে ৭ শতাংশ। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিও স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল না। তারও কিছুটা প্রভাব পড়েছে রাজ্যের রাজস্ব আদায়ে। বাজেট বক্তৃতাতেও কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষারোপ করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “ভারত সরকার একতরফা ভাবে রাজ্যকে কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের ক্ষতিপূরণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর ফলে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ২০১০-১১ এবং ২০১১-১২ সালে ১৮০০ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।” পাশাপাশি কেন্দ্র বিমান সংস্থাগুলিকে বিদেশ থেকে জ্বালানি (এটিএফ) কেনার অনুমতি দেওয়ায় বিক্রয়কর বাবদ রাজ্যের বছরে ২২৫ কোটি টাকা কম আদায় হবে বলে আশঙ্কা।
অথর্মন্ত্রীর দাবি, এ সত্ত্বেও বাজেট প্রস্তাবে উন্নয়নের জন্য ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে।
বাজেটের কাগজ নিয়ে চলেছেন মানস ভুঁইয়া।
মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, “যদি আদায় বাড়ে, তা হলে উন্নয়ন খাতে ব্যয় আরও বাড়ানো হবে কথা দিচ্ছি।” মমতা জানান, সাধারণ মানুষের উপর কর না-চাপিয়ে আয় বাড়ানোর নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করবে সরকার। উদাহরণ হিসেবে তিনি সল্টলেকে জমির হাতবদল থেকে রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা কমানোর রাস্তায় হেঁটে অর্থমন্ত্রী পনির, ঘুড়ি বানানোর কাঠি, বেলুন, রান্নার গ্যাসের খালি সিলিন্ডারের মতো কয়েকটি পণ্যে কোথাও কর কমিয়েছেন, কোথাও একেবারেই মকুব করে দিয়েছেন। বৃত্তি করের নিম্ন সীমা মাসিক ৩০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০০ টাকায় নিয়ে গিয়েছেন। এর ফলে নিম্ন আয়ের বহু মানুষ উপকৃত হবেন বলে তাঁর দাবি।
অর্থমন্ত্রী কর বাড়িয়েছেন ১০ লক্ষ টাকার বেশি দামি গাড়ি, ২০ হাজার টাকার উপরে মোবাইল ফোন, ১৫ হাজার টাকার উপরে ঘড়ি, ২৫ হাজার টাকার উপরে টেলিভিশন এবং এক টনের উপরে এসি মেশিনে। দেশি মদের উপরেও নতুন কর ব্যবস্থা চালু করে বাড়তি আয়ের রাস্তা করতে চেয়েছেন। এবং দক্ষতা বাড়িয়ে আয়বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর আদায় ব্যবস্থাকে আরও সরলীকরণ করেছেন, ছাড় দিয়েছেন অনেক ছোট ব্যবসায়ীদেরও।
উন্নয়নের জন্য অর্থমন্ত্রী পরিকল্পনা খাতে ২৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা খরচ করবেন, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি। অমিতবাবু সব মিলিয়ে যা আয় করবেন, তার থেকে খরচ করবেন ৯ কোটি টাকা বেশি। যদিও রাজকোষ ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ২৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার উপরে। যা রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রীর নিজের কথায় ‘মা-মাটি-মানুষের’ এই বাজেটে উন্নয়নের লক্ষ্য হবে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র শিল্প। কিন্তু এই খাতে যে ২৮৬ কোটি টাকা তিনি পরিকল্পনা বরাদ্দ রাখছেন, তা কী ভাবে খরচ করা হবে তার কোনও দিশা স্পষ্ট হয়নি বাজেট প্রস্তাবে। ঠিক একই ভাবে ৫০০ কোটি টাকা তিনি দিয়েছেন বড় শিল্পের জন্য। কিন্তু ‘এক জানলা’ অনুমোদন ব্যবস্থার বাইরে এই টাকা কী ভাবে খরচ করা হবে, তারও কোনও স্পষ্ট দিশা বাজেট প্রস্তাবে নেই। কার্যত নেই বড় শিল্পের জন্য পরিকাঠামো তৈরি নিয়ে কোনও পরিকল্পনা। তবে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য অর্থমন্ত্রী কলকাতার বাইরে ফলতা, বর্ধমান ইত্যাদি শহরে পরিকাঠামো তৈরির কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন রয়েছে সোনারপুরে ‘হার্ডওয়্যার পার্ক’ তৈরির কথা। তবে সোনারপুরের এই প্রকল্পটি বামফ্রন্টের আমলেই প্রস্তাবিত হয়েছিল।
বাজেট শুনছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, আনিসুর রহমান এবং সুশান্ত ঘোষ।
আগামী আর্থিক বছরে ১১টি অনুন্নত জেলায় মোট ১০৪৬ কিলোমিটার রাস্তা চওড়া করা ও ৮টি সেতু নির্মাণের পাশাপাশি বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের স্বার্থে সড়ক উন্নয়ন, উৎপাদন কেন্দ্রের সঙ্গে বিপণন কেন্দ্রকে যুক্ত করতে নতুন সড়ক নির্মাণ এবং গুদাম ব্যবস্থার উন্নতির কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এই কাজের জন্য অর্থ সংস্থান করতেই প্রবেশ কর ফিরিয়ে আনার পথে হেঁটেছেন অমিতবাবু।
সাম্প্রতিক রাজনীতিতে পাহাড় ও জঙ্গলমহল বর্তমান সরকারের কিস্তির বোড়ে হিসেবে উঠে এসেছে। বাজেট প্রস্তাবেও তাই স্বাভাবিক ভাবেই জায়গা করে নিয়েছে সুন্দরবন-সহ ওই দুই অঞ্চল। অর্থমন্ত্রীর দাবি, সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই অঞ্চল বঞ্চিতই থেকে গিয়েছে। সেই বঞ্চনা দূর করতে পশ্চিমাঞ্চলকে ২০৫ কোটি টাকা, সুন্দরবনকে ২৫০ কোটি টাকা পরিককল্পনা খাতে দিয়েছেন তিনি। উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্য রেখেছেন ২০০ কোটি টাকা। আর পাহাড়কে দিচ্ছেন ১১৮ কোটি।
এই বাজেটের চমক? সেই ঘাটতির অঙ্কই। অর্থমন্ত্রী গত বছর রাজস্ব ঘাটতির প্রস্তাব করেছিলেন ৮ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। বছর শেষ করেছেন ১৭ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতিতে। এতদসত্ত্বেও তিনি আত্মবিশ্বাসী। তাই তাঁর প্রস্তাব ৬ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির। বছর শেষে দেখার একটাই, অমিতবাবু পারলেন কি না! তবে প্রত্যয়ী মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, “লক্ষ্যমাত্রার থেকে বেশি আয় করব।”

— নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.