না আছে ২৪ ঘণ্টার আরএমও, না আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স।
অথচ দিব্যি ব্যবসা চলছে। বর্ধমান শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে এ রকম বেশ কিছু নার্সিংহোম। যেগুলির অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা দূরস্থান, অবস্থা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়।
অপ্রস্তুত বেশির ভাগই। তার চেয়েও বড় কথা, একটি নার্সিংহোমেরও অগ্নি নির্বাপণের ছাড়পত্র নেই!
প্রশাসনের চরিত্রই হল, বেশির ভাগ সময়ে আগুনের ছ্যাঁকা লাগলে তবে ঘুম ভাঙে। গত বছর ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পরে স্বাস্থ্য দফচরের কর্তারা নড়েচড়ে বসেছিলেন। বর্ধমানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নার্সিংহোমগুলিতে আগুন নেভানোর কী ব্যবস্থা আছে, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ এসেছিল। দু’চার দিন নার্সিংহোমে ‘পরিদর্শন’ করে বেড়াচ্ছিলেন কর্তারা।
তার পরে ফের যে কে সেই!
|
এসএসকেএম হাসপাতাল এবং মেদিনীপুরের একটি নার্সিংহোমে আগুন লাগার পরের দিন, বৃহস্পতিবার বর্ধমান শহরের বিভিন্ন নার্সিংহোমে ঘুরে দেখা গেল, পরিস্থিতির বিশেষ কিছু বদল ঘটেনি। অপরিসর গলির মধ্যে চলছে এমন কয়েকটি নার্সিংহোম, যেখানে আগুন লাগলে দমকল পর্যন্ত ঢুকতে পারবে না।
বিজয় তোরণ এলাকার একটি নার্সিংহোমের কথাই ধরা যাক। বি সি রোড থেকে যে সরু গলি দিয়ে সেখানে ঢুকতে হয়, সেটি দিয়ে এক সঙ্গে এক জনের বেশি লোকের চলা সম্ভব নয়। নার্সিংহোমের ভিতরে ঢুকতে খাড়া সিঁড়ি। আগুন লাগলে দমকল কর্মীদের পক্ষে কিছু করা কার্যত অসাধ্য। কেন এমন অপরিসর জায়গায় নার্সিংহোম চালাচ্ছেন? নার্সিংহোমের মালিক নিরুত্তর!
রানিসায়রে আবার একটি নার্সিংহোম চলছে, যা দেখলে পোড়ো বাড়ি ছাড়া কিছু মনে হয় না। আপাতত কোনও অনুমোদন ছাড়াই পাঁচ শয্যার ওই নার্সিংহোম চলছে বলে অভিযোগ। না আছে ‘ফায়ার লাইসেন্স’, না আছে আগুন মোকাবিলার ব্যবস্থা। তবে সেটির ম্যানেজারের দাবি, “নার্সিংহোমের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্য দফতরে আবেদন করেছি। লাইসেন্স মিললে শয্যার সংখ্যা বাড়াব। তখন সমস্ত পরিকাঠামোই ঢেলে সাজা হবে।”
কয়েক দিন আগে জেনারেটর থেকে আগুন লেগেছিল বড়বাজারের একটি নার্সিংহোমে। মায়েরা সদ্যোজাতদের নিয়ে আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেন। পরে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, আগুন লাগেনি, শুধু ধোঁঁয়া দেখা গিয়েছিল। ওই নার্সিংহোমে গিয়ে দেখা যায়, যে জেনারেটর থেকে আগুন লেগেছিল, সেটি আগের মতোই খোলা আকাশের নীচে পড়ে রয়েছে। নার্সিংহোমটির কর্ণধার অবশ্য মন্তব্য করেন, “আপনাদের কাজ নেই? সামান্য ঘটনা নিয়ে বারবার লিখছেন!” |
পরিস্থিতি যে যথেষ্ট সঙ্কটজনক, জেলা প্রশাসনের কর্তারা কিন্তু তা ভালই জানেন।
ভারপ্রাপ্ত জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিশীথ মণ্ডলের আশ্বাস, “আমরা নার্সিংহোমের তালিকা তৈরি করছি। কারা ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশন্টে অ্যাক্ট’ মানছে বা মানছে না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার বিষয়টি দেখছে দমকল। বেশ কিছু নার্সিংহোমের অবস্থা সত্যিই বেহাল। সেগুলি যাতে আর লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করাতে না পারে, সে দিকে নজর রাখা হবে।”
বর্ধমান দমকল কেন্দ্রের ওসি তপন মুখোপাধ্যায় বলেন, “ফায়ার লাইসেন্স পেতে হলে নার্সিংহোমগুলিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পুরসভা ইত্যাদি দফতর থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ নিতে হয়। সেগুলি পেতে অনেক নার্সিংহোমেরই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। তবে আমরাও বলেছি, সমস্ত নথিপত্র আমাদের কাছে জমা পড়ার পরেই আমরা লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে তদন্ত শুরু করব। এখনও শহরের কোনও নার্সিংহোমই অগ্নিনির্বাপণ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পায়নি।”
বর্ধমান নার্সিংহোম মালিক সমিতির সভাপতি শ্যামপদ শ্যাম অবশ্য বলেন, “আমরি কাণ্ডের পরে জরুরি বৈঠক ডেকে সদস্যদের সাবধান করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব ফায়ার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতেও বলা হয়েছে। ৯০ শতাংশ সদস্যই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। সময় মতো স্বাস্থ্য দফতরের লাইসেন্স নিতেও বলা হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, “অতীতে অপরিকল্পিত ভাবে অনেকগুলি নার্সিংহোম হয়েছিল। তাদেরও বলা হয়েছে, যতটা সম্ভব আগুন মোকাবিলা করার ব্যবস্থা রাখুন। অনেকে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে ওয়াটার রিজার্ভারও বসিয়েছেন।”
আগুনের ‘রক্ষাকবচ’ নিতে সত্যিই কি এঁদের বাধ্য করতে পারবে প্রশাসন? |