বেসমেন্টের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। চার দিকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। একতলা ছাড়িয়ে দোতলা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে সেই ধোঁয়া। এই পরিস্থিতিতে কী করবেন, আর কী করবেন না ভেবেই পাচ্ছিলেন না মেদিনীপুরের বেসরকারি হাসপাতালটিতে ভর্তি রোগী ও তাঁদের পরিজনেরা। ফিরে আসছিল আমরি-র আতঙ্ক। কেউ ভাবছিলেন এখনই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে পড়াই ঠিক হবে। কেউ ভাবছিলেন, নীচে তো চার দিকেই ধোঁয়া। সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে গেলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে। তার চেয়ে বরং চার-পাঁচতলায় চলে যাওয়াই ভাল।
বুধবারের ঘটনা পরম্পরা বৃহস্পতিবারেও ফিরে ফিরে আসছিল রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের মুখে। কেউই সেই ‘দুঃস্বপ্ন’ ভুলতে পারছেন না। রবীন্দ্রনগরের ওই বেসরকারি হাসপাতালেই ভর্তি ছিলেন বৃদ্ধা বিজলিপ্রভা চৌধুরী। বয়স প্রায় নব্বই ছুঁইছুঁই। বাড়ি গড়বেতার সানমুড়া গ্রামে। শুরুতে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। পরে সেখান থেকে তাঁকে সাধারণ শয্যায় স্থানান্তরিত করা হয়। বৃদ্ধার ছেলে সুব্রত চৌধুরী বলেন, “কী ভাবে মা-কে হাসপাতাল থেকে বের করব, শুরুতে ভেবেই পাচ্ছিলাম না। পরে সিঁড়ি বেয়েই নীচে নামি। তখনও একতলাটা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে রয়েছে। তার মধ্যেই কোনও ভাবে বেরোই।” উদ্ধারের পর বৃদ্ধাকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেখান থেকে তাঁকে শহরেরই অন্য এক নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়।
রবীন্দ্রনগরের বেসরকারি হাসপাতালটিতে ভর্তি ২১ জন রোগীকে বুধবার মেদিনীপুর মেডিক্যালে আনা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন বৃহস্পতিবার শহরের অন্য হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় কয়েক জন বাড়িও ফিরে গিয়েছেন। মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসা পরিষেবায় সবাই খুশি। মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, একাংশ রোগীর আত্মীয়ই বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে যেতে চেয়েছেন। সেই মতোই চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে তাঁদের ছাড়া হয়েছে। যাঁরা এখনও ভর্তি রয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসা যথাযথ ভাবে চলছে বলে জানিয়েছেন মেডিক্যালের সুপার রামনারায়ণ মাইতি। তাঁর কথায়, “ঠিক মতোই চিকিৎসা চলছে।’’
মেদিনীপুর মেডিক্যালের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন ওই বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আসা ৩ জন রোগী। তাঁদেরই এক জন নীলকণ্ঠ দাস। আগে কলকাতার এক হাসপাতালেও চিকিৎসা করিয়েছেন। তাঁর ছেলে মিহির বলেন, “বুধবার সকালটার কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠছি। বাবা-কে যে কী ভাবে বের করে এখানে এনেছি, তা আমরাই জানি।” তবে, ওই বৃদ্ধকে মেডিক্যালে ভর্তি করার পরেও এক দফা সমস্যায় পড়েন মিহির। তাঁর মতো এমন সমস্যায় অনেকেই পড়েছেন বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর। আইসিইউতে ভর্তি করার পরে চিকিৎসকেরা প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র দেখতে চান। কিন্তু শুরুতে কাগজপত্র দেখাতে পারেননি নীলকণ্ঠবাবুর পরিবারের লোকজন। কাগজপত্র রয়ে গিয়েছিল বেসরকারি হাসপাতালটিতেই। সেখানে গিয়ে তা খুঁজে পেতেও সময় লাগে। মিহির বলেন, “শুরুতে ওখানকার কর্তৃপক্ষ কাগজপত্র দিতেই চাইছিলেন না। ওঁরা বলেন, কাগজপত্র পেতে সময় লাগবে। পরে জোরাজুরি করতে ওঁরা কাগজপত্র দেন।”
তবে বুধবার দুপুরের পর থেকে বেসরকারি হাসপাতালটির কিছু কর্মী রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে আলাদা ভাবে বসেন। সেখান থেকেই কাগজপত্র সংগ্রহ করে নিয়ে যান রোগীর পরিজন।
বৃহস্পতিবার সকালেও এ ভাবেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বন্ধ হাসপাতালটির সামনে বসেছিলেন সুদীপ্তা মাইতি, সুস্মিতা নন্দী, সঙ্গীতা চক্রবর্তীরা। তাঁরা সকলেই ওই হাসপাতালের কর্মী। সুদীপ্তা বলেন, “বুধবারের ঘটনা নিছকই দুর্ঘটনা। আমরা রোগীদের পাশে থেকেছি। এখনও সব রকম সহযোগিতা করছি।” সুস্মিতা-র কথায়, “রোগীর পরিবারের লোকজনদের সমস্যার কথা ভেবেই এ ভাবে কাগজপত্র নিয়ে বসেছি।” বুধবার রাতেই হাসপাতালটি ‘সিল’ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ মোতায়েনও হয়েছে। হাসপাতাল সংলগ্ন দু’টি রাস্তায় ব্যারিকেড থাকায় আবার স্থানীয়দের একাংশ ক্ষুব্ধ। তাঁদের বক্তব্য, এর ফলে একেই সংকীর্ণ গলিপথে চলাফেরায় সমস্যা হচ্ছে। |