|
|
|
|
সময় দিচ্ছি, নিচ্ছেন না: সূর্য |
সব বলতে হাজার পাতা লাগত, বিধানসভায় বললেন মুখ্যমন্ত্রী |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
তাঁর সরকারের প্রথম ১০০ দিনের মাথায় যা বলেছিলেন, দশ মাস পূর্ণ করেও তা-ই বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা, “এই দশ মাসে গর্ব করে বলতে পারি, মা-মাটি-মানুষ অনেক পেয়েছে। অনেকটাই করে দিয়েছি। বাকি যেটুকু আছে, করে দেব। এর পরে আর কেউ কিছু বলতে পারবেন না!”
বস্তুত, রাজ্যপালের ‘কষ্টে’র কথা ভেবেই তাঁর ভাষণে রাজ্য সরকারের সব ‘সাফল্যে’র খতিয়ান দেওয়া যায়নি বলেও বিধানসভায় জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী! যে কোনও রাজ্য সরকারই তাদের ‘সাফল্যে’র কথা রাজ্যপালের ভাষণে লিপিবদ্ধ করে এবং ‘নেতিবাচক’ দিকগুলি কেন নেই, তা নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তোলে। রাজ্য বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে এ বার রাজ্যপালের ভাষণ ঘিরে বিতর্কেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু রাজ্যপালের ভাষণের উপরে বৃহস্পতিবার জবাবি ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী আরও কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছেন। সরাসরিই বলেছেন, “প্রথম ১০০ দিনের কাজের একটা বই করেছিলাম। ২০০ দিনের কাজও লিপিবদ্ধ হয়েছে। এত কাজ করা হয়েছে যে, বই মোটা হয়ে যাচ্ছে! সব কথা বলতে গেলে আমাকে তো হাজার পাতার বই করতে হবে!” এর সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রীর সংযোজন, “রাজ্যপাল প্রবীণ মানুষ। তিনি কত ক্ষণ পড়বেন? এই বই-ই প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পড়েছেন। তার পরে আমি বলেছিলাম, ওঁকে একটু জল দিন! রেলমন্ত্রী হিসাবে বাজেট পেশ করেছি তো। আমি জানি, টানা এই ভাবে বলতে কী কষ্ট হয়।” বাম জমানায় ২০০৬, ২০০৯ ও ২০১০ সালের রাজ্যপালের ভাষণের বই দু’হাতে মাথার উপরে তুলে দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আগে রাজ্যপালের ভাষণে কী থাকত, সব তিনি দেখে রেখেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর জবাবি বক্তৃতার মনোভাব দেখে যত না ‘বিস্মিত’, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি ‘আমোদিত’ বিরোধী শিবির। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র পরে বলেছেন, “বিধানসভায় মোটামুটি একটা জনসভার ভাষণ শোনা গেল! এর কোনও জবাব দেওয়া মুশকিল। ব্যাপার হল, আমরা ওঁকে সময় দিতে চাই। কিন্তু উনি সময় নিতে চাইছেন না! উনি ৯-১০ মাসেই সব করে ছাড়বেন! এতে আমাদেরও মুশকিল, ওঁরও দাঁড়াতে সমস্যা হবে!”
মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই এ দিন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা বলেন, “স্পিকার বলেছিলেন এক কথার পুনরাবৃত্তি না-করতে। এটা ভাল পরামর্শ। এক কথা বারবার শুনতে ভাল লাগে না। প্রশ্নের উত্তর না-পেয়ে আমাদের অবশ্য মাঝে মাঝে এক কথা বারবার বলতে হয়। কিন্তু সরকার পক্ষ ৩৪ বছরের পুনরাবৃত্তি কবে বন্ধ করবেন? যত ৩৪ বছরের গায়ে কালি লাগানোর চেষ্টা করবেন, তত ওটা জ্বলজ্বল করবে!” প্রবল চিৎকার শুরু করেন তৃণমূল বিধায়কেরা। মুখ্যমন্ত্রীর ইশারাতেই তাঁদের চুপ করতে নির্দেশ দেন শাসক পক্ষের পরিষদীয় নেতৃত্ব। পরে নিজের বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা বলেন, “গণতন্ত্রে কিছু ব্যাপার থাকে। ’৭২ থেকে ’৭৭ (কংগ্রেস জমানা) শুনতে শুনতে কান পচে গিয়েছে! আপনারা যখন ’৭২-৭৭ বলেছেন, তা হলে আপনাদেরও ৩৫ বছর শুনতে হবে!” রাজ্যের কৃষি সঙ্কট, আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি, পাহাড় ও জঙ্গলমহলের সমস্যা, সিঙ্গুরের জমির জট, সরকারি চাকরিতে অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্নিয়োগের নীতি-সহ একগুচ্ছ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সূর্যবাবু। জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ ‘ভাল ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেও সূর্যবাবুর প্রশ্ন ছিল, “বামপন্থী যে সব মানুষ মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন, তাঁদের কথা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু জঙ্গলমহলে চিকিৎসক, নার্স, নির্বাচন কর্মী, পুলিশ, শিলদার আধা-সামরিক জওয়ান বা জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের যাত্রীরা কেউ তো কোনও রাজনৈতিক দলের টিকিট কাটেননি। নিরপরাধ মানুষদের যারা খুন করল, তাদের কি কোনও বিচার হবে না? যারা তাদের (মাওবাদী) প্রতিহত করার জন্য লড়ল, তাদেরই বেছে বেছে ধরা হবে, এটা কি ন্যায়বিচার?” সূর্যবাবুর ইঙ্গিত সুশান্ত ঘোষদের দিকে বুঝেই শোরগোল শুরু করেন তৃণমূল বিধায়কেরা।
জবাবি ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নির্দিষ্ট উত্তরের দিকে যাননি। আদালতের সবুজ সঙ্কেত পেলেই সিঙ্গুরের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা ‘বসে’ আছেন বলে জানিয়েছেন। আর আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে তাঁর সাফ বক্তব্য, “একটা ঘটনা নিয়ে (পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড) কেউ কেউ টিআরপি বাড়ানোর জন্য হইচই করেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের নিজেদের মতামত থাকতেই পারে। যে দিন ওই ঘটনা ঘটে, সেই দিনই দিল্লিতে ৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। তা নিয়ে তো কেউ কিছু বলেননি?” যা শুনে সূর্যবাবু পরে বলেছেন, “এ বার থেকে তা হলে কলকাতার সংবাদমাধ্যম দিল্লির ঘটনা আর দিল্লির সংবাদমাধ্যম কলকাতার ঘটনা রিপোর্ট করবে! তা হলে উনি খুশি হবেন হয়তো!” বিরোধীদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আরও পরামর্শ, “তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে আপনাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই! নিজেদের দল সামলান! তৃণমূল বাংলার সম্পদ, এটা মনে রাখবেন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে দলটা গড়ে তুলতে হয়েছে।” নিজের দলের বিধায়কদের প্রতিও তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর ‘বার্তা’, এক একটা সংবাদমাধ্যম এক এক রকম লিখবে। ভাবার দরকার নেই।” যার প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দলনেতা বলেছেন, “তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে বসে অন্তর্দ্বন্দ্ব হলে কারও মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু মারপিট তো হচ্ছে স্কুলে, কলেজে, বাজারে, রাস্তাঘাটে সর্বত্র। পুলিশের জিপে হামলা হচ্ছে। পরিবারে এমন কলহ হলে যদি পড়শিরা টিকতে না-পারে, তা হলে কী করা যাবে?”
যে কোনও বিতর্কে অংশগ্রহণকারী বিধায়কদের বক্তব্য থেকে উঠে-আসা প্রশ্নের জবাব যে ভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দেন, মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তৃতা ছিল তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। বিরোধী দলনেতা এবং তার আগে তৃণমূলের রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া রাজ্যপালের ভাষণের উপরে গোটা বিতর্কের কোনও অংশই তিনি স্বকর্ণে শোনেননি। রাজীব দাবি করেন, “সরকারের সব কাজ বলতে গেলে রাজ্যপালের ভাষণ ৩৬ থেকে ৩৬০ পাতা হত!” জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য উল্লেখ করে বামফ্রন্ট এবং বর্তমান সরকারের আমলের আইনশৃঙ্খলার তুলনামূলক চিত্রও হাজির করার চেষ্টা করেন তিনি। যার সূত্র ধরে মুখ্যমন্ত্রী ‘হাজার পাতা’র কথা বলেন, কিছু পরিসংখ্যানও টানেন। শিশুমৃত্যু ‘সামাজিক সমস্যা’ বলে অভিহিত করেন। বিতর্কের শুরুতে এ দিন ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক উদয়ন গুহ বলেছিলেন, মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন পরিবর্তন করে ২৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘটকে এ রাজ্যে প্রথম ‘সমর্থন’ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাই! কিন্তু তিনিই পরে সরকারি কর্মচারীদের সম্পর্কে অন্য পথে চলে গেলেন! মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য পরিষ্কারই বলেন, “বাংলার মানুষ ধর্মঘট-বন্ধ-অবরোধ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। চারটে লোক মিলে একটা বন্ধ বা অবরোধ করে দিলাম, আমার দল বা যে-ই হোক, এটা আর চলবে না!” আর সব শেষে তাঁর প্রত্যয়ী ঘোষণা “দশ মাসে ঝড়ের গতিতে চেষ্টা করেছি কাজ করে নিয়ে যাওয়ার!” |
|
|
|
|
|