পুত্র অর্জুন থেকে স্ত্রী অঞ্জলি তেন্ডুলকর। দাদা অজিতের আত্মত্যাগ। কী মনে হত এক বছরের ওপর সেঞ্চুরি না পাওয়ার সেই সময়টায়? শততম সেঞ্চুরি পূরণ করার পরের সকালে তাঁকে নিয়ে প্রবল হুড়োহুড়ির মধ্যে সমস্ত ধাঁধার উত্তর দিয়ে গেলেন সচিন তেন্ডুলকর।
প্রশ্ন: অর্জুনের সঙ্গে কী কথা হল?
সচিন: অর্জুনের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে উঠতে পারিনি এখনও। তবে কথা হয়েছে পরিবারের বাকি সকলের সঙ্গে।
প্র: পরিবার আপনার সঙ্গে এখানে কবে যোগ দিচ্ছে?
সচিন: না, ওরা এখানে আসছে না। টুর্নামেন্ট চলছে। কাল আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ।
প্র: তার মানে এখন কোনও সেলিব্রেশন হচ্ছে না?
সচিন: কী বলছেন? সেলিব্রেশন! কাল পাকিস্তান ম্যাচ। আমাদের জিততে হবে। এর মধ্যে সেলিব্রেশন কী!
প্র: কাল রাতে মাঠ থেকে ফেরার পর থেকে যত বার শততম সেঞ্চুরির কথা ভাবছেন, সবথেকে বেশি করে কী মনে পড়ছে?
সচিন: মনে হচ্ছে যে, টার্গেটের সামনে এসেও অনেক সময় আপনি আটকে যেতে পারেন। তবু প্রাণপণ চেষ্টা করে যেতে হবে। মাঝেমাঝে কিছুটা ভাগ্যের সহায়তাও দরকার হয় শেষ হার্ডলটা পেরোনোর জন্য। মনে হচ্ছে, সেই ভাগ্যের সহায়তাটা আমি পাচ্ছিলাম না। আমি অনেক বার সেঞ্চুরির কাছাকাছি এসেছি গত এক বছরে। ওভালে। মুম্বইয়ে। অস্ট্রেলিয়ায়। কিছুটা দিল্লিতেও। এমন নয় যে আমি ভাল ব্যাট করছিলাম না। কিন্তু ১০০ সংখ্যাটা শুধু পাওয়া হচ্ছিল না।
প্র: এই যে নিরানব্বই সেঞ্চুরির পর থেকে প্রত্যেকটা ইনিংস যখন ব্যাট হাতে বাইশ গজের দিকে যেতেন কী ভাবনা চলত মনের মধ্যে?
সচিন: নিরানব্বই সেঞ্চুরির পর থেকে বলে নয়। জীবনের প্রথম দিন থেকে ব্যাট হাতে নিয়ে বাইশ গজের দিকে যেতে যেতে যেটা ভাবতাম, এই ইনিংসগুলোতেও সেটাই ভেবেছি। আমি টিমের জন্য অবদান রাখতে চাই। আমার সেরা অবদান। কখনও সেটাকে ছাপিয়ে আমার মাথার মধ্যে শততম সেঞ্চুরি বড় হয়ে দাঁড়ায়নি। |
প্র: কাল মাঠ থেকে ফেরার পর নিজেকে এক বারও প্রশ্ন করেছেন, এত দীর্ঘ সময় কেন লাগল?
সচিন: (হাসি) ঈশ্বরের হয়তো নিজের একটা ধরন আছে এক-একজনের পরীক্ষা নেওয়ার!
প্র: এই যে তেত্রিশটা ইনিংস যেখানে আপনি সেঞ্চুরি পাননি সেই সময় পরিবারের আপনজনদের মধ্যে কী চলছিল সেটা জানতে ইচ্ছে করছে। বাড়িতে এখন তো আপনার এক খুদে ক্রিকেটারও আছে। অর্জুন তেন্ডুলকর। সে কী বলছিল? বাবাকে তো সে বেশি সেঞ্চুরি করতেই দেখেছে। সেঞ্চুরির কাছ থেকে ফিরতে নয়।
সচিন: (হাসি) আমি নিশ্চিত পরিবারের ওপর দিয়েও অনেক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে। ওরা সেটা আমার সামনে প্রকাশ করত না। চিরকাল আমার পরিবার এটাই করেছে। চেষ্টা করেছে যতটা সম্ভব বাড়িতে আমাকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক লোকের মতো রাখতে। ওই শততম সেঞ্চুরিটা বাদ দিয়ে ওরা অন্যান্য জিনিস নিয়ে কথা বলত। দাদা অজিতের কথা বলতে চাই। অনেক ব্যাপার নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করত। স্ত্রী আলোচনা করত। আমার ক্রিকেটের জন্য আমার দাদার অনেক অনেক আত্মত্যাগ আছে। শততম সেঞ্চুরিটা আমি ওকে উৎসর্গ করতে চাই। আমরা একসঙ্গে আমাদের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থেকেছি। যখনই আমি ব্যাট করতে নেমেছি আমি জানতাম মানসিক ভাবে ও আমার সঙ্গে আছে। সাড়ে বাইশ বছর ধরে ও এটা করছে। এটা শুধু আমার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সময়ের কথা বললাম। কিন্তু কিশোর হিসেবে যে দিন থেকে আমি ক্রিকেট ব্যাট হাতে তুলেছি, যে দিন থেকে প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছি, সে দিন থেকেই দাদা এটা করে যাচ্ছে। নিজের কেরিয়ার ত্যাগ করেছে শুধু আমার ক্রিকেট কেরিয়ারকে গড়বে বলে।
অর্জুন আর সারাকে নিয়ে বলব, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, ওরা ওদের মতো করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাক। আর-পাঁচটা বাচ্চা যেমন তাদের ছেলেবেলাকে উপভোগ করে সে রকম করুক। আমাকে যে রকম মিডিয়া ঘিরে রেখেছে, সেটা যেন এখনই ওদের নিয়ে না হয়।
অর্জুন পাগলের মতো ক্রিকেটকে ভালবাসতে শুরু করেছে। আমি চাই না, এখনই ওকে মিডিয়া ঘিরে ধরুক। ও যখন নিজে এ সব সামলাতে শিখবে তখন ঠিক আছে। এত অল্প বয়সে মিডিয়ার চাপ তৈরি হয়ে গেলে ও খুব দ্রুত এ সবকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। সেটা হোক আমি চাই না। ওকে আস্তে আস্তে এর সঙ্গে বেড়ে উঠতে হবে। জীবনের সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। পরিস্থিতি আছে। আমি তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ করব, অর্জুনকে ওর মতো বেড়ে উঠতে দিন। যখন সময় আসবে তখন নিশ্চয়ই ও নিজের সেই পরিণতিবোধটা দেখাবে, কী করে মিডিয়াকে সামলাতে হয়। আমি এটুকু আপনাদের বলতে পারি যে, বাবা হয়ে আমি নিজেও খুব একটা এর মধ্যে নাক গলাই না।
প্র: আপনার প্রথম ওয়ান ডে সেঞ্চুরি আসতেও দেরি হয়েছিল। সেই অপেক্ষা আর শততম সেঞ্চুরির অপেক্ষার মধ্যে কী মিল?
সচিন: প্রচণ্ড অমিল (হাসি)...ওই সময় আপনারা আমার সেঞ্চুরি না পাওয়া নিয়ে মোটেও এত লেখালেখি করেননি। তাই কখনও সেঞ্চুরির ওজনটা মাথার ওপর চেপে বসেনি। তখন আমি শুধু ক্রিকেটকে উপভোগ করেই যাচ্ছিলাম। দু’টো খুব আলাদা দু’টো পরিস্থিতি। এই সেঞ্চুরিটা না পেয়ে অনেক বেশি হতাশা তৈরি হচ্ছিল। জানি না, কী ভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করব। মনে হচ্ছে, আমাকে যদি এই সময়টা ‘গাইড’ করার কেউ থাকত! কেউ যদি বোঝানোর জন্য থাকত, কী ভাবে এই পরিস্থিতিকে সামলাতে হয়। আমি কোনও অভিযোগ করছি না কিন্তু এটাও খুব সত্যি কথা যে, আমার জীবনে এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এই প্রথম বার পড়লাম। আমার পরিবার, বন্ধুদের উপস্থিতিটা নিশ্চয়ই খুব সাহায্য করেছিল। আমার হতাশার কথা, অপ্রাপ্তির কথা ওদের বলতে পারতাম। বলতাম দেখো, আমি তো খারাপ ব্যাট করছি না। তবু সবাই সেঞ্চুরি না হওয়া নিয়েই বলে যাচ্ছে। দিল্লি টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যেমন দ্বিতীয় ইনিংসে আমি যখন ব্যাট করতে গেলাম বেশ কঠিন পরিস্থিতি। সেখান থেকে আমরা ম্যাচ জিতলাম। আমি রান করলাম। কিন্তু তার পরেও আমার অবদান নিয়ে কেউ কথা বলছিল না। বলছিল আমার সেঞ্চুরি না হওয়া নিয়ে। এটা কোনও স্পোর্টসম্যানই চাইবে না। চাইবে না টিমের প্রতি অবদান রেখেও শুনতে যে, সে কী পেল না।
প্র: আপনার এই শততম সেঞ্চুরির জন্য অপেক্ষার সঙ্গে কি অন্যান্য স্পোর্টের কিংবদন্তিদের অপেক্ষার তুলনা করা যায়। যেমন ফেডেরারের ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতার জন্য প্রতীক্ষা?
সচিন: আমি জানি না ফেডেরারকে কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। আমি ফ্রেঞ্চ ওপেনের সঙ্গে শততম সেঞ্চুরির তুলনা করব না। ফেডেরারের ফ্রেঞ্চ ওপেনের জন্য অপেক্ষার সঙ্গে একমাত্র তুলনা হতে পারে বিশ্বকাপের। আমাকে যেটার জন্য বাইশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফেডেরারের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। এগুলো স্পোর্টসম্যানের জীবনের অঙ্গ। এমন একজন প্লেয়ারকে আমি এখনও দেখিনি, যে কখনও খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যায়নি। লক্ষ্যপূরণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। একটা কথা হাত তুলে আমি বলতে পারি। আমার ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ বা দায়বদ্ধতা নিয়ে যেন কেউ কথা বলতে না আসে। আমার খাতায় অন্তত এই দু’টো ব্যাপারে আমি একশোয় একশো।
প্র: এমন কোনও ইনিংস আছে যেটা ভীষণ শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে খেলেছেন?
সচিন: অনেক।
প্র: এখনই যেটার কথা মনে পড়ছে...
সচিন: গ্বালিয়রে ওয়ান ডে ডাবল হান্ড্রেড। মনে আছে, ম্যাচের আগে আমি ফিজিওর টেবিলে পড়েছিলাম। আমার পুরো শরীরটা নিয়েই সমস্যা ছিল। আমরা আলোচনা করছিলাম আজই সিরিজটা জিতে নিই। তার পর আমি বোর্ডকে অনুরোধ করব বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। আমি আর পারছি না। দু’শো করে ড্রেসিংরুমে ফেরার পর টিমের অনেকে বলেছিল, তুমি বিধ্বস্ত! আর পারছ না ধকল নিতে! |