আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও এই নীতি কি নিজেই মানেন রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র?
পরিবহণ মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “দফতরের খরচ কমাতে আমি এবং পরিবহণ সচিব সরকারি গাড়ি নেব না।” মদনবাবু আজও কিন্তু তাঁর সরকারি গাড়িটি ছাড়েননি। সে গাড়ির জন্য প্রতিদিন ৩০ লিটারের বেশি তেল বরাদ্দ হচ্ছে বলে পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে। ওই সূত্র জানাচ্ছেন, মন্ত্রীর মতো পরিবহণ সচিবও দিব্য সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। সেই গাড়ির জন্যও তেল বরাদ্দ হচ্ছে পরিবহণ দফতর থেকেই।
মন্ত্রীর ভবানীপুরের বাড়ি আর মহাকরণের মধ্যে দূরত্ব বড় জোর পাঁচ কিলোমিটার। এই দূরত্বের জন্য দৈনিক গড়ে ৩০ লিটার তেল কী ভাবে লাগছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। কলকাতা শহরের মধ্যে যে সব মন্ত্রী থাকেন, বাড়ি থেকে অফিস যাতায়াতে তাঁদের গাড়ির জন্য সাধারণত দু-আড়াই লিটার তেল লাগে। কখনও দূরে যেতে হয় বলে মন্ত্রীদের গাড়ির জন্য দৈনিক আট লিটার তেল বরাদ্দ হওয়ার কথা। ২০০৪ সালেই লিখিত ভাবে রাজ্য সরকার মন্ত্রী-আমলাদের জন্য এই নির্দেশিকা জারি করেছিল। সেই নির্দেশিকাই এখনও কার্যকর রয়েছে।
অর্থাভাবে পরিবহণ-নিগমের কর্মীদের বেতন দিতেই সঙ্কটে পড়েছে রাজ্য সরকার। কিছু পরিবহণ কর্মী অভাবে পড়ে আত্মঘাতীও হয়েছেন। পরিবহণ দফতর ব্যয়সঙ্কোচ নীতি নিচ্ছে বলে ঘোষণা করেছিলেন মদনবাবু। ৩ ফেব্রুয়ারি মহাকরণে তিনি বলেন, “সিদ্ধান্ত হয়েছে আমি এবং পরিবহণসচিব সরকারি গাড়ি নেব না। প্রতিটি কাঁচা পয়সার হিসাব রাখতে হবে।” কোন গাড়ির কত তেল লাগছে, কোন গাড়ি দৈনিক কত কিলোমিটার চলছে, তার হিসেব পেতে প্রতিটি সরকারি গাড়ির লগবুক রাখা বাধ্যতামূলক করেন তিনি।
এর পরেও মাসখানেক আগে মন্ত্রী বলেন, “যিনি এত দিন দৈনিক ২০ লিটার তেল খরচ করতেন, তাঁকে সেই খরচ পাঁচ লিটারে সীমাবদ্ধ রাখতে বলা হয়েছে। দফতরের অফিসার-কর্মীরা হুটহাট গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। এ বার থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি ছাড়া তাঁরা দফতর ছাড়তে পারবেন না।”
কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কি? বাম আমলে পরিবহণ মন্ত্রী ছিলেন রঞ্জিত কুণ্ডু। তাঁর বাড়ি ছিল নৈহাটি। সরকারি গাড়ি চেপেই নৈহাটি থেকে মহাকরণ যাতায়াত করতেন তিনি। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি, এই তিন মাসে রঞ্জিতবাবুর গাড়ির জন্য তেল লেগেছিল ৫৫০ লিটার। বাড়ি থেকে অফিস যাতায়াত ছাড়া এর মধ্যে অন্য সরকারি সফরও ছিল। আর মদনবাবুর সরকারি গাড়ির লগবুক থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি এই তিন মাসে তাঁর গাড়ির জন্য তেল লেগেছে ২ হাজার ৭০২ লিটার, রঞ্জিতবাবুর চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। গাড়িটি চলেছে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার।
তা এখন কী বলছেন পরিবহণ মন্ত্রী?
মদনবাবু বলেন, “আসলে ফেব্রুয়ারি মাসে আমি বলতে চেয়েছিলাম পরিবহণ দফতরের সরকারি গাড়ি নেব না। সাংবাদিকের কথাটা বুঝতে ভুল হয়েছিল। আর পরিবহণ সচিবের গাড়ির বিষয়টা বলতে পারব না।” এত তেল যে ব্যবহার করছেন? মদনবাবুর ব্যাখ্যা, “মন্ত্রীদের গাড়ির জন্য যে তেলের ‘কোটা’ রয়েছে, তা আমার জানা নেই। সরকারি কাজে ঘুরতে হচ্ছে বলে তেল লাগছে।”
সরকারি কোটা থাকা সত্ত্বেও কেন অর্থ দফতর এই খাতে অর্থ মঞ্জুরে সতর্ক হচ্ছে না?
অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের জবাব, “ওটা পরিবহণ দফতরের দেখার কথা। ওদের জিজ্ঞাসা করুন।”
বাম আমলে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের গাড়ির জন্য তেল বরাদ্দ হত মাসে গড়ে ২২০ লিটার। আর, ২০১১-র ডিসেম্বর থেকে ২০১২-র ফেব্রুয়ারি এই তিন মাসে ওই দফতরের বর্তমান মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের গাড়ির জন্য তেল লেগেছে ১,৭৫০ লিটার, অর্থাৎ মাসে ৬০০ লিটারের কাছাকাছি। লগবুক থেকে দেখা যাচ্ছে, এই তিন মাসে তিনি ঘুরেছেন ১৩,২৮১ কিলোমিটার। মদনবাবুর মতো ফিরহাদেরও ব্যাখ্যা, তেল বরাদ্দে কোটা আছে, তাঁর জানা ছিল না। এক বছর আগের শ্রমমন্ত্রী অনাদি সাহুর গাড়ির তুলনায় বর্তমান শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর গাড়িও ছুটছে মাসে প্রায় চার গুণ বেশি। পূর্ণেন্দুবাবুর উত্তর, “আমি উত্তরপাড়া থেকে যাতায়াত করি। তেল তো লাগবেই। এটুকু বলতে পারি,পরিবারের কেউ আমার গাড়ি ব্যবহার করেন না।” |