প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁহার বাজেট ভাষণে একটি খেদোক্তি করিয়াছেন তাঁহার চাকরিটি নেহাত সুখের নহে! কথাটি যে কত দূর সত্য, তাহা এই বাজেটে অতি স্পষ্ট। অর্থনীতি তাঁহার নিকট দুইটি দাবি পেশ করিয়াছিল। এক, রাজকোষ ঘাটতি সামাল দিতে হইবে; দুই, আর্থিক বৃদ্ধির হারের যে গতিভঙ্গ হইয়াছে, তাহা মেরামত করিতে হইবে। কাজ দুইটি বিপরীতমুখী। রাজকোষ ঘাটতি সামাল দিতে হইলে কঠোর রাজস্ব নীতির পথে হাঁটিতে হয়। কিন্তু, কঠোর রাজস্ব নীতি মানেই বৃদ্ধির হারে তাহার কু-প্রভাব পড়িবে। মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য টাকা না থাকিলে চাহিদায় টান পড়িবে। তাহার প্রভাব পড়িবে শিল্পক্ষেত্রে। ভারতীয় অর্থনীতির গতিভঙ্গের প্রধানতম কারণ হইল, ২০১১-১২ অর্থবর্ষে বিভিন্ন কারণে শিল্প-উৎপাদন ক্ষেত্রটি একেবারে ধরাশায়ী হইয়াছে। তাহার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়া বিপজ্জনক। অর্থনীতির এই বিপরীতমুখী দুইটি কারণই অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বটিকে ‘অসম্ভব’ করিয়া তুলিতে যথেষ্ট। তাহার উপর যোগ হইয়াছে শরিকি রাজনীতির টানাপোড়েন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বটেই, সরকারের কোনও শরিকই বিনা প্রতিবাদে কঠোর রাজস্ব নীতি হজম করিতে সম্মত হইবেন না। রাজনীতি ও অর্থনীতির এই মোক্ষম চোরাবালিতে দাঁড়াইয়া শ্রীমুখোপাধ্যায়কে বাজেট প্রস্তুত করিতে হইয়াছে। ফলে, তাঁহার প্রতিটি পদক্ষেপই যে অতি সাবধানী হইবে, তাহা বিচিত্র কী?
আশার কথা, অর্থমন্ত্রী অন্তত পরিস্থিতিটি সম্যক বুঝিয়াছেন, এবং নিজের কর্তব্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হইয়াছেন। তিনি ব্যয় হ্রাসের প্রকল্পটিকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করেন নাই, রাজস্ব বাড়াইবার চেষ্টা হইতেও হাত গুটাইয়া লন নাই। সত্য, যত দূর যাওয়া প্রয়োজন ছিল, তাঁহার বাধ্যবাধকতা অর্থমন্ত্রীকে সেই দূরত্ব অতিক্রম করিতে দেয় নাই। কিন্তু, এই বাজেটে তাঁহার দায়িত্বশীলতার অভ্রান্ত ছাপ রহিয়াছে। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে তিনি ভর্তুকির পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দুই শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখিতে চাহেন। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে ভর্তুকির পরিমাণ অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ২.৫ শতাংশে পৌঁছাইয়াছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধি এই ভর্তুকি-স্ফীতির একটি বড় কারণ। অর্থমন্ত্রী যখন ঘাটতির পরিমাণ কমাইয়া আনিবার পরিকল্পনা করিতেছেন, তখন অনুমান করা চলে, দেশের বাজারে ডিজেলের মূল্য হইতে নিয়ন্ত্রণ সরাইয়া লইবার চিন্তা সম্ভবত তাঁহার আছে। প্রতি বাজেটেই যে প্রচুর অবান্তর ব্যয়বাহুল্য থাকে, এই বাজেটে সেগুলির দাপট লক্ষণীয় ভাবে কম। প্রণববাবু যে ক্ষেত্রগুলিতে বড় আকারে ব্যয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহার প্রায় প্রতিটিতেই দীর্ঘমেয়াদে মূলধন গঠনের সম্ভাবনা আছে। রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তিনি পরোক্ষ করের উপর নির্ভর করিয়াছেন। অর্থমন্ত্রী রসিকতা করিয়া বলিয়াছেন, ভারতে পরিষেবা করের বয়ঃক্রম অষ্টাদশ বৎসর অতিক্রম করায় তাহা এখন সাবালক, ফলে তাহাকে আরও দায়িত্ব লইতে হইবে। সেই ব্যবস্থা হইয়াছে। উৎপাদন শুল্কের হার বাড়িয়াছে, কিন্তু তাহা এখনও মন্দা-পূর্ববর্তী হারের তুলনায় কম। ফলে, রাজস্ব আদায়ের এই পথটিকে মন্দ বলিবার উপায় নাই। সর্ব অর্থেই এই বাজেটের মূল সুর দায়িত্বশীলতার। বাস্তবের সহিত সঙ্গতি রাখিয়া চলিবার দায়িত্বশীলতা। রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ৫.১ শতাংশে রাখাও সেই দায়িত্বশীলতারই পরিচায়ক।
তবু একটি প্রশ্ন থাকিয়াই যায়। অর্থমন্ত্রীর এই বাজেট, তাহার সমস্ত লক্ষ্যমাত্রা, পরিকল্পনা সবই বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। মুশকিল হইল, তাহার কোনওটিই অর্থমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন নহে। ইরানে যুদ্ধ বাধিলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়িয়া কোথায় ঠেকিবে, তাহা অনুমানের অসাধ্য। তেলের দাম সেই পরিমাণ বাড়িলে তাহা যে দেশের বাজারে ক্রেতাদের উপর চালান করিয়া দেওয়া হইবে না, রাজনীতির সমীকরণ তাহা নিশ্চিত করিয়াই রাখিয়াছে। ফলে, রাজকোষের উপর সেই বোঝা চাপানো ভিন্ন উপায়ান্তর থাকিবে না। ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংকট কী চেহারা লইবে, তাহাও অনিশ্চিত। অবশ্য, অনিশ্চয়তা যে শুধু বহির্বিশ্বে, তাহা নহে। ইউ পি এ সরকারের শরিকি রাজনীতি কোন মোড় লইবে, সরকার কলিকাতার মুখাপেক্ষী থাকিবে না কি লখনউ-এর, এই প্রশ্নগুলিরও কোনও উত্তর আপাতত নাই। এই প্রশ্নগুলির উপর ভারতীয় অর্থনীতি প্রভূত পরিমাণে নির্ভরশীল। কাজেই, বর্তমান বাজেট, তাহার যাবতীয় দোষ-গুণ সমেত, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারিবে কি না, আপাতত তাহা প্রশ্নমাত্র। |