|
|
|
|
আখেরে ‘ভাল’ চান, তাই ‘নির্মম’ প্রণব |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
রাহুল দ্রাবিড় কি অবসর ভেঙে ফিরে এলেন?
দীনেশ ত্রিবেদীর রেল বাজেট বিরাট কোহলির ঝোড়ো ইনিংস হলে, আজ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাজেট ফের যেন ফিরিয়ে আনল ভারতীয় ক্রিকেটের ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’কে। যিনি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। যাঁর ইনিংসে কোনও চটুল চমক নেই। গ্যালারিতে ঢেউ তোলার জন্য যিনি ঝুঁকি নিতে নারাজ।
দেশের অর্থনীতির সমস্যাগুলো কী এবং কোথায়, প্রণববাবু তা জানেন। আর তা জেনেই রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টেনে আর্থিক শৃঙ্খলার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তিনি। প্রণববাবু এটাও জানেন যে, দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির পথে দেশের
|
সংসদে ঢোকার ঠিক
আগে। ছবি: এ এফ পি |
অর্থনীতিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, কিন্তু তার জন্য কোনও ঝুঁকি নেওয়ার সময় এখনও আসেনি। বাজেটে তাই কোনও ঝুঁকি তিনি নেননি। করের হার বাড়াতে গিয়ে ‘নির্মম’ হওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু পরিষেবা কর ও উৎপাদন শুল্কের হার খুব বেশি বাড়াননি। আবার আয়করেও বেশি ছাড় দেননি। সামাজিক ক্ষেত্রে খরচের ব্যাপারেও সংযত থাকার চেষ্টা করেছেন। বাজেটে তাই কোনও চমক নেই। সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে যেটুকু করা সম্ভব ছিল, সেইটুকুই করেছেন অর্থমন্ত্রী। এক জন দক্ষ কারিগরের মতো আটঘাট বেঁধে সমস্ত হিসেবনিকেশ কষে এ বছরের বাজেট তৈরি করেছেন তিনি। দিনের শেষে এক কথায় যাকে বলা চলে ‘দায়িত্বশীল বাজেট’।
আগামী আর্থিক বছরের বাজেট তৈরি করতে যাওয়ার আগে একেবারে সাঁড়াশির মুখে পড়েছিলেন প্রণববাবু। এক দিকে আন্তর্জাতিক মন্দা এবং তার ধাক্কায় দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, অন্য দিকে বিপুল রাজকোষ ঘাটতি এবং চড়া হারে মূল্যবৃদ্ধি। রাজকোষ ঘাটতি জিডিপি-র ৪.৬%-এর লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে এ বছর ৫.৯%-এ গিয়ে পৌঁছেছে। আগামী বছরে তা এক ধাক্কায় ৫.১%-এ নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মন্দা না-থাকলে তিনি রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি জোর দিতে পারতেন। ব্যয় সঙ্কোচ করে, করের হার বাড়িয়ে আরও বেশি আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু তা হলে মন্দার বাজারে শিল্পোৎপাদন ধাক্কা খেত। আর্থিক বৃদ্ধি আরও কমত। আবার, উল্টো পথটাও ছিল প্রণববাবুর সামনে। তা হল, রাজকোষ ঘাটতির কথা ভুলে গিয়ে শুধুই আর্থিক বৃদ্ধির কথা ভাবা। তার জন্য শিল্পে কর ছাড় বজায় রেখে বা আরও বাড়িয়ে ‘স্টিমুলাস’-এর কথা ভাবতে পারতেন। কিন্তু তা হলে ঘাটতি বাড়ত, মূল্যবৃদ্ধিও। এই দুটো পথের কোনওটাই নেননি, বরং একটা মধ্যপন্থায় হেঁটেছেন। হেঁটেছেন বাস্তব রাজনৈতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখেই।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য সব ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি তুলে নেওয়া সম্ভব নয়, তা-ও প্রবীণ অর্থমন্ত্রীর অজানা ছিল না। একশো দিনের কাজ বা ভবিষ্যতে খাদ্য নিশ্চয়তা প্রকল্পের কথাও তাঁকে মাথায় রাখতে হয়েছে। অতএব খাদ্য নিশ্চয়তা প্রকল্পে পুরো ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ডিজেল, কেরোসিন, রান্নার গ্যাস বা সারের ক্ষেত্রে গরিব মানুষের হাতে সরাসরি নগদ ভর্তুকি তুলে দিয়ে ভর্তুকির বহর কমানোর কথা বলেছেন, যাতে মোট ভর্তুকির পরিমাণ আগামী বছরে জিডিপি-র ২%-এ বেঁধে রাখা যায়। তেল সংস্থাগুলিকে দেওয়া ভর্তুকি ৬৫ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করতে চান প্রণববাবু। সারের উপর ভর্তুকি ৬ হাজার কোটি টাকা কমানোরও প্রস্তাব রয়েছে।
এই পথেই ভর্তুকির অনুপাত আগামী তিন বছরে ১.৭৫%-এ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তাঁকে চিন্তায় রাখছে অপরিশোধিত তেলের দাম। আজও বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল ১২৪ ডলার। প্রণববাবুর হিসেবে, আগামী বছরে তেলের দাম গড়পড়তা ১১৫ ডলারের কাছাকাছি থাকবে। কিন্তু ইরানের পরিস্থিতি খারাপ
হয়ে তেলের দাম বাড়লে, সব হিসেবই উল্টে যেতে পারে।
যেমনটা চলতি বছরে হয়েছে নানা কারণে। বিলগ্নিকরণ থেকে রাজস্ব বাবদ আয়, অপরিশোধিত তেলের দাম থেকে শিল্পোৎপাদনের হার-- গত বারের বাজেটে এ সব বিষয়ে প্রণববাবুর যে হিসেব ছিল, তার কোনওটাই মেলেনি। এ বারের বাজেটে তাই তিনি আয় ও ব্যয়ের অনুমান কষতে গিয়ে যতটা সম্ভব বাস্তববাদী থাকার চেষ্টা করেছেন। বিলগ্নিকরণ থেকে গত বছর ৪০ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিলেন। শেয়ার বাজারের টালমাটাল অবস্থার জন্য তার অর্ধেকও হয়নি। এ বার তাই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩০ হাজার কোটিতে নামিয়ে এনেছেন। এ বছরই সরকারের হাতে থাকা বাড়তি স্পেকট্রাম এবং নতুন করে টু-জি স্পেকট্রাম নিলাম হবে। এ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা আয় হবে ধরে নিয়ে ‘রক্ষণশীল’ হিসেব কষা হয়েছে। যদিও বাস্তবে নিলামে অনেক বেশি দাম ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বছরে প্রণববাবুর অন্যতম মাথাব্যথ্যার কারণ ছিল কর বাবদ আয় কমে যাওয়া। এ বার কর বাবদ আয় বাড়াতে প্রত্যক্ষ কর বিধি (ডিটিসি) ও পণ্য-পরিষেবা করের (জিএসটি) মূল সূত্রগুলি চালু করে দিচ্ছেন তিনি। আয়করে ছাড়ের সীমা বাড়িয়েছেন। দেশি-বিদেশি সংস্থার মধ্যে মালিকানার হাত বদলের উপর কর বসানোর বন্দোবস্ত করেছেন। পরিষেবা কর ও উৎপাদন শুল্কের হার ১০% থেকে বাড়িয়ে ১২% করেছেন। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম সামান্য বাড়লেও মূল্যবৃদ্ধিতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলেই প্রণববাবুর দাবি। পণ্য-পরিষেবা কর প্রায় চালু করে দিয়ে সামান্য কিছু ক্ষেত্র বাদে সব ক্ষেত্রেই পরিষেবা কর বসিয়েছেন। সমস্ত সম্ভাব্য জায়গা থেকে খুঁটে খুঁটে রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। প্রণববাবুর হিসেব, সব মিলিয়ে আগামী বছরে কর বাবদ আয় ৪১,৪৪০ কোটি টাকা বাড়তে চলেছে। তবে উৎপাদন শুল্ক বাড়ালেও শিল্পমহলকে সদর্থক বার্তা দিতে মন্দার ধাক্কায় যে সব শিল্পক্ষেত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেগুলিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা হয়েছে। আর্থিক বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুৎ, কয়লা, সড়কের মতো জরুরি পরিকাঠামোর উন্নতিতেও জোর দিয়েছেন তিনি।
|
চিকিৎসা শাস্ত্রে অনেক সময়ই এমন কিছু করতে হয়, যা স্বল্পমেয়াদে যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শুভ। আর্থিক নীতির ব্যাপারটাও তেমনই। শেক্সপিয়রের কলমে ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট যেমন বলেছিল, “আই মাস্ট বি ক্রুয়েল ওনলি টু বি কাইন্ড (সদয় হওয়ার জন্যই আমাকে নির্মম হতে হবে)।”
প্রণব মুখোপাধ্যায় |
----------------------------------- |
হ্যামলেট নাটকের তৃতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্য। হ্যামলেট এসেছে তার মা গারট্রুডের ঘরে। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে তার প্রেমিকা ওফেলিয়ার বাবা পলোনিয়াস। কথা বলতে বলতে হ্যামলেট অজান্তেই তরবারির খোঁচায় পলোনিয়াসকে হত্যা করে বসে। সেই হত্যা প্রসঙ্গেই সে বলে, “আই মাস্ট বি ক্রুয়েল টু বি কাইন্ড।” হ্যামলেট জানে, পলোনিয়াসের মৃত্যুই সব নয়। ভবিষ্যতে রাজা ক্লডিয়াসকেও হত্যা করতে হবে। প্রাণনাশ নির্মম কাজ হলেও ডেনমার্কের ভালর জন্য সেটাই দরকার। হ্যামলেট তাই মাকে বলে, “আমি অনুতপ্ত। কিন্তু স্বর্গবাসী দেবতাদের ইচ্ছা এমনই ছিল যে!”
উইলিয়াম শেক্সপিয়র |
|
|
অর্থমন্ত্রীর নিজের ভাষায়, “আমার সামনে তিনটি লক্ষ্য ছিল। এক, অর্থনীতিকে কী ভাবে বৃদ্ধির পথে ফেরানো যায়। দুই, কী ভাবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তিন, রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টেনে কী ভাবে সকলকে সামিল করে আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব।” প্রণববাবুর দাবি, বাজেটে এই তিনটি ক্ষেত্রেই স্পষ্ট দিক্নির্দেশ রয়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়া হয়েছে। পূর্বাঞ্চলে সবুজ বিপ্লবের জন্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উন্নয়নে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। ‘ইউরো’ অঞ্চল, আমেরিকা বা জাপান যখন মন্দার কবলে, তখন ভারতের বাজারকে আন্তর্জাতিক পুঁজির ‘নিশ্চিত গন্তব্যস্থল’ করে তুলতে চেয়েছেন তিনি। যার জন্য মূলধনী বাজারে সংস্কারের চেষ্টা করে বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থা বা প্রত্যক্ষ বিনিয়োগকারীদের কাছে সদর্থক বার্তা পাঠাতে চেয়েছেন। আবার বিদেশি বিনিয়োগ হঠাৎ করে চলে গেলে শেয়ার বাজার যাতে টলে না-যায়, তার জন্য এ দেশের মানুষের সঞ্চয় বাড়ানো ও তা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে চেয়েছেন তিনি। শুধু রাজকোষ ঘাটতি নয়, কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি কমাতেও সোনার উপরে আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছেন তিনি। কারণ অপরিশোধিত তেলের পরেই সব থেকে বেশি আমদানি হচ্ছে সোনা। আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে সেটায় রাশ টানতে পারলে বিদেশি মুদ্রার অপচয় বন্ধ হবে বলেই প্রণববাবুর আশা।
অর্থমন্ত্রী জানেন, বাজেটেই সব সংস্কার করে ফেলা সম্ভব নয়। তাঁর বক্তব্য, “সংস্কার একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া।” তাই বাজেটেই পরেও সংসদের চলতি অধিবেশনে আর্থিক সংস্কারের জন্য তিনি গোটা দশেক বিল পাশ করাতে চান বলে জানিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতাতেই সেই তালিকা দিয়ে দিয়েছেন তিনি। |
|
|
|
|
|