‘দাদা, বাংলাদেশ ম্যাচটার জন্যই কি ধইরা রাখছিল?’
বৃহস্পতিবারের ঢাকায় যেন জাতীয় স্লোগানের মতো চলল এই প্রশ্ন। কী রাস্তাঘাটে! কী মীরপুরের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সচিন যখন নেটে ব্যাট করছেন! টিম হোটেলের লবিতে! ব্যাঙ্কে!
সচিন তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরি নিয়ে বাজনা তো গত এক বছর ধরে চলছে। আর সেই অধরা সেঞ্চুরি না হতে হতে আগ্রহটাতেই যেন ভাঁটা পড়ে যাচ্ছিল। শুক্রবার এশিয়া কাপের ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ সেটাকে আবার চাঙ্গা করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবারের পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ পর্যন্ত মীরপুরের মাঠে এক-তৃতীয়াংশও ভর্তি হতে দেখা যানি কোনও ম্যাচে। এ দিন সেখানে ভাল মতো টিকিটের চাহিদা। সবথেকে বেশি যার প্রভাব টের পাচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা। কলকাতা নাইট রাইডার্সের অলরাউন্ডার সাকিব-আল-হাসানকে দেখা গেল টিকিটের খোঁজ করছেন। শাহদাত হোসেনকে দেখা গেল ফোনে কাউকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন, দেখতাছি... কী ব্যবস্থা হয়। |
হতে পারে যে, বাংলাদেশ তুলনামূলক ভাবে দুর্বল প্রতিপক্ষ হওয়ায় একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, সচিন এই ম্যাচেও ব্যর্থ হবেন কী করে? এটা একান্তই জনতার ধারণা যেখানে ক্রিকেট-আবেগ আছে। ক্রিকেট-বিশ্লেষণ নেই। কারণ ক্রিকেট-বিশ্লেষণ বলবে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এগারোটা ওয়ান ডে খেলে সচিনের আজ পর্যন্ত কোনও সেঞ্চুরি নেই। সর্বোচ্চ ৮২ নট আউট। ২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২৮ করে আউট হয়ে যান। বরং দগদগে ঘা আছে। ২০০৭ বিশ্বকাপে এদের কাছেই হেরে কাপ থেকে ছিটকে যাওয়া।
সেই টিমের অন্যতম পেসার মাশরাফি মর্তুজা শুক্রবারের মীরপুর স্টেডিয়ামেও থাকবেন নতুন বল হাতে সচিনের বিরুদ্ধে। অতীতে মাশরাফির তাঁর বিরুদ্ধে সফল হওয়ার উদাহরণ আছে। আর ২০০৭ বিশ্বকাপের সেই অভিশপ্ত ম্যাচে যিনি তাঁর উইকেট নিয়েছিলেন সেই বাঁ হাতি স্পিনার আব্দুর রজ্জাকও থাকছেন। এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে এই বাংলাদেশ টিম ৫০ ওভারে ২৬২-তে বেঁধে রেখেছিল, এটাও জরুরি তথ্য। বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহমান বললেন, “সচিনের জন্য আমাদের অবশ্যই আলাদা প্ল্যান থাকে। আমরা চাই ও শততম সেঞ্চুরি করুক। কিন্তু আমাদের সঙ্গে নয়। কারণ আমাদের সঙ্গে সেঞ্চুরি করলে তো ভারত অনেক রান তুলে ফেলবে। তা হলে আমরা জিতব কী করে?”
অতীতের সচিন হলে এ সব বক্তব্য শুনে পরের দিন ‘হা রে রে’ করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যেমন হেনরি ওলঙ্গার এক বার হয়েছিল। এখানে মাত্র এক দিন আগেও সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। নেটে রাহুল শর্মার লম্ফঝম্প দেখে যখন তাঁকে ওড়ালেন। শুক্রবারের ম্যাচে তাঁর ক্রোধ আছড়ে পড়ে কি না সেটাই দেখার।
আর ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট যদি যুক্তি দেখায় বাংলাদেশকে হেলাফেলা করছি না বলেই উইনিং কম্বিনেশন ভাঙব না, তা হলে সেটাকে আষাড়ে বক্তব্যই বলা উচিত। এক দিকে তরুণ প্রজন্মের টিম গড়ে তোলার স্লোগান শোনানো হচ্ছে। অথচ শেষ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেও দিনের পর দিন শুধু উপেক্ষাই পেয়ে চলেছেন মনোজ তিওয়ারি। বাংলাদেশ ম্যাচেও খেলানোর কোনও কথাবার্তা নেই। এমনকী ঠিক মতো তাঁকে নেটেও ব্যাটিং করানো হচ্ছে না। এ দিন অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। রবীন্দ্র জাডেজা অত্যন্ত দায়সারা মনোভাব নিয়ে ব্যাটিং করে গেলেন। চার থেকে পাঁচ বার বোল্ড হলেন তিনি। দেখে মনেই হবে না দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার কোনও ইচ্ছা আছে বলে। মনে হবে আইপিএলের সবথেকে দামী, বখাটে এক ক্রিকেটার। শুধু টি-টোয়েন্টিই খেলেন। এ দিকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছিলেন। ধোনিদের নেটে ব্যাটিং করে গেলেন। মাঠে ম্যাচ পারফর্ম করছেন না। মাঠের বাইরে শৃঙ্খলাভঙ্গের নানা কাহিনি শোনা যাচ্ছে। অথচ দিনের পর দিন তাঁরাই খেলে যাচ্ছেন। মনোজের মতো দায়বদ্ধ ক্রিকেট-নিবেদিতদের জন্য বরাদ্দ শুধুই উপেক্ষা আর বঞ্চনা।
এমনও শোনা যাচ্ছে যে, অস্ট্রেলিয়াতেও মনোজকে নেটে ঠিক মতো ব্যাটিং দেওয়া হত না। কোচ ডানকান ফ্লেচার একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু করেছেন। ম্যাচে যাঁরা খেলবেন নেটে তাঁদেরই শুধু গুরুত্ব দিয়ে ব্যাটিং করানো। বাকিরা যেন দুয়োরানির ছেলে। প্রশ্ন উঠছে, ম্যাচ না খেলে খেলে এমনিতেই মনোজের মতো ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানের ধার কমে যেতে বাধ্য। তার উপর নেটেও যদি তিনি নিয়মিত ব্যাটিং অনুশীলনের সুযোগ না পান তা হলে তো আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি উবে যাবে!
ধোনি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, রোহিত শর্মাকে খেলিয়ে যাওয়া হচ্ছে কারণ ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যতের স্বার্থে রোহিতকে দরকার। এই সময়টায় খেলিয়ে খেলিয়ে যদি রোহিতকে দাঁড় করিয়ে নেওয়া যায় তা হলে নাকি ভারতীয় ক্রিকেটের উপকার হবে। মনোজ তিওয়ারিকে দাঁড় করাতে পারলে ভারতীয় ক্রিকেট উপকৃত হবে না, এটা তাঁকে কে বলল? আর মনোজকে তো রোহিত বা রায়নার মতো দয়া দেখিয়ে খেলাতে হচ্ছে না। তিনি শেষ ম্যাচে সেঞ্চুরি করে বসে আছেন। স্রেফ ক্রিকেটীয় যোগ্যতা এবং ফর্মেই তিনি প্রথম একাদশে জায়গা পান।
টিম ম্যানেজমেন্টে কেউ এ নিয়ে বলার নেই। অধিনায়কের ভোট আছে। কোচের ভোট আছে। বলবে কে? অস্ট্রেলিয়ার মতো এখানে প্রথম একাদশ নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচকদের ভোট নেই। নির্বাচকেরা শুধু ষোলো জনের স্কোয়াডে কাউকে রাখতে পারেন। প্রথম একাদশে স্থান নিশ্চিত করার অধিকার নেই।
এক-এক বার মনে হচ্ছে, বীরেন্দ্র সহবাগের আচমকা বিতর্কিত হয়ে গিয়ে এশিয়া কাপ খেলতে না আসা। গৌতম গম্ভীরের সহ-অধিনায়কত্ব হারানো। এতে আরও একবগ্গা হয়ে গিয়েছে টিমের কাণ্ডকারখানা। গুরু গ্রেগ যা-ই বলুন, সহবাগ-গম্ভীরদের বিরুদ্ধে চেষ্টা করেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ কেউ আনতে পারবে না। ফিটনেস নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগী না হওয়ার অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু কখনও টিম কার্ফু ভেঙেছেন বলে উদাহরণ নেই। নারীঘটিত বিতর্কের কাহিনি নেই। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, পাল্টা মত দেওয়ার একটা গলাও ছিল।
বোর্ড এবং শ্রীকান্তের জাতীয় নির্বাচক কমিটির বিস্ময়কর পদক্ষেপে সেটা উড়ে গেল। আর যিনি বলতে পারতেন তিনি আজ চুপচাপ। অস্ট্রেলিয়া-উত্তর টিমের মধ্যেও খুব বেশি কিছু বলছেন-টলছেন না। একে রান পাচ্ছেন না। শততম সেঞ্চুরির খোঁজ চলছে। তার উপর অস্ট্রেলিয়া বিতর্কের চোরাবালিতে যে তিনিও পড়ে গিয়েছিলেন। মীরপুরের মাঠে শুক্রবার যদি অধরা শততম সেঞ্চুরিটা হয়ে যায়, তৎক্ষণাৎ বোধ হয় আর একটা প্রতীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। সচিন রমেশ তেন্ডুলকর কি মুখ খুলবেন? |