ধর্মের নামে অধর্মের দৃষ্টান্ত নূতন নয়, বিরলও নয়, বস্তুত মহাভারতপ্রমাণ। তবে জোটধর্মের নামে যে পরিমাণ অধর্ম আধুনিক ভারতে আচরিত হইয়া থাকে, তাহা বোধ করি শ্রীযুক্ত বেদব্যাসেরও দুষ্পাচ্য হইত। দীনেশ ত্রিবেদীর রেল বাজেট লইয়া সেই অধর্মের ইতিহাসে নূতন পর্ব যুক্ত হইতে চলিয়াছে, এমন আশঙ্কা বিপুল। ব্রিটিশ তথা ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় শাসনতন্ত্রে মন্ত্রিসভার উপর শাসক দলের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ একটি মৌলিক সত্য। মৌলিক সমস্যাও বটে। যতক্ষণ প্রধানমন্ত্রী (বা, রাজ্যস্তরে, মুখ্যমন্ত্রী) শাসক দলেরও অবিসংবাদিত প্রধান, ততক্ষণ গোল নাই, কিন্তু সেই সূত্রটি ছিন্ন হইলেই সমস্যা প্রকট হয়, তখন দলের নেতা বা নেতৃবৃন্দ তথা হাইকমান্ড প্রধানমন্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব করিতে থাকেন, ফলে সরকারের প্রধান হইয়াও তিনি দলের আজ্ঞা বহন করিয়া চলেন। জোট সরকারের ক্ষেত্রে এই অনাচারে নূতন মাত্রা যুক্ত হয়। তখন মন্ত্রিসভার গঠন হইতে শুরু করিয়া তাহার নীতি ও কার্যকলাপ, সব কিছুর উপর প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত ও বিপর্যস্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁহার মন্ত্রিসভার প্রধান, কিন্তু সেই মন্ত্রিসভায় কে সদস্য হইবেন, কে হইবেন না, তাহাও সম্পূর্ণত তাঁহার হাতে থাকে না, শাসক জোটের বিভিন্ন শরিক দলের ‘কোটা’য় যে সব দফতর চিহ্নিত হয়, সেই সব দফতরের মন্ত্রী কে হইবেন, তাহা সেই দলের নেতারাই স্থির করেন। ইহাই জোটধর্ম হিসাবে প্রচলিত এবং প্রচলনসিদ্ধ। ইহার বিস্তর নমুনা বামফ্রন্ট শাসিত পশ্চিমবঙ্গ যুগের পর যুগ দেখিয়াছে, জ্যোতি বসু হইতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বিভিন্ন শরিক দলের জন্য চিহ্নিত দফতরগুলিতে অনন্তকাল তাহাদের পছন্দসই মন্ত্রীদের বহাল রাখিয়াছেন, সেই মন্ত্রীরা অপটু, অদক্ষ, এমনকী কার্যত অথর্ব হইলেও। রেলমন্ত্রীর আসন হইতে দীনেশ ত্রিবেদীকে অপসারণ করিয়া সেই আসনে মুকুল রায়কে অধিষ্ঠিত করিতে হইবে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের উদ্দেশে প্রেরিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘নির্দেশিকা’ সেই ধারায় নূতনতম সংযোজন।
ভীষণতমও বটে। রেল বাজেটকে কেন্দ্র করিয়া যাহা ঘটিতেছে তাহা সত্যই ‘থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড’। কিন্তু ইহাকে কেবল উদ্ভটনাট্য বলিলে অত্যন্ত কম বলা হইবে। এই ঘটনাবলি শাসনতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর, বিপজ্জনক। সংসদীয় ব্যবস্থায় শাসনবিভাগ আইনসভার নিকট দায়বদ্ধ, সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালনের জন্যই বাজেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্ত লইয়া আইনসভায় বিতর্কের রীতি প্রচলিত, এবং সেই সিদ্ধান্তে আইনসভার অনুমোদন প্রয়োজনীয়। রেল বাজেটের ক্ষেত্রেও সেই রীতি অনুসৃত হওয়া উচিত, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আপত্তিতে বাজেট বলবৎ না হইলে কিছু বলিবার ছিল না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁহার দলীয় অনুগামীদের অপছন্দ বলিয়া বাজেট রদ করিতে হইবে, এই দাবি অত্যন্ত অসঙ্গত ও অনৈতিক। প্রধানমন্ত্রী তথা তাঁহার মন্ত্রিসভার পক্ষে অপমানজনকও বটে। দীনেশ ত্রিবেদীর রেল বাজেটটি তাঁহার ব্যক্তিগত অভিপ্রায়ের সনদ নহে, নীতিগত ভাবে তাহা সমগ্র মন্ত্রিসভার প্রস্তাব, কারণ সংসদীয় শাসনতন্ত্রে মন্ত্রিসভার সদস্যদের দায়িত্ব একক নহে, যৌথ। একটি দলের নেত্রী এক হুঙ্কারে বা একটি পত্রাঘাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নাকচ করিয়া দিতেছেন, এই দৃশ্য ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে শ্লাঘার নয়। অথচ, জোটধর্মের নামে এমনটিই ভারতে প্রবল বিক্রমে চলিতেছে। জোট রাজনীতির বর্ধমান প্রতিপত্তি দেখিয়া আশঙ্কা হয়, বিক্রম উত্তরোত্তর প্রবলতর হইবে। রেলমন্ত্রী মন্তব্য করিয়াছেন, যাঁহারা ভাবিয়াছিলেন রেল বাজেট মহাকরণে রচিত হইয়াছে, তাঁহারা ভুল ভাবিয়াছিলেন। ইহা নিশ্চয়ই পরম গৌরবের কথা। কে রেলমন্ত্রী হইবেন, রেল বাজেট কী ভাবে সংশোধিত হইবে, তাহার চিত্রনাট্য যদি মহাকরণে রচিত হয়, তাহা হইবে চরম অগৌরবের। |