জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন। তবে সুরতাল বোধ যথেষ্ট। হাতের সামনে তবলা পড়লে সুর খেলে। পড়াশোনা করে তবলা শিক্ষক হতে চান রায়গঞ্জের সুদর্শনপুর দ্বারিকাপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যাচক্র স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বিশ্বপ্রিয় দাস। সাধারণ স্কুলে পড়েই এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছেন তিনি। শিক্ষকদের কাছ থেকে পড়া বোঝার পরে বাড়িতে ব্রেইল পদ্ধতিতে তা অভ্যাস করতেন তিনি। বুধবার লেখকের সাহায্য নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তিনিও পরীক্ষা দিলেন। লেখক প্রতিবেশী দশম শ্রেণির ছাত্র অমিত পাল। বিশ্বপ্রিয় দৃষ্টিহীন হওয়ায় সংসদ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরীক্ষার নির্দিষ্ট তিন ঘন্টা ছাড়াও অতিরিক্ত এক ঘন্টা বরাদ্দ করেছিল। অতিরিক্ত সময়ের আধ ঘন্টা আগেই হাসিমুখে অমিতের হাত ধরে তিনি রায়গঞ্জ মোহনবাটি হাই স্কুলের পরীক্ষার হল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন বিশ্বপ্রিয়। প্রথম দিনের পরীক্ষার শেষে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, “কলকাতার একটি স্কুল ছাড়া ব্রেইল পদ্ধতিতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনার কোনও ব্যবস্থা নেই। শারীরিক অসুবিধার কারণে সেই স্কুলে ভর্তি হতে পারিনি। দু’বছর সাধারণ পড়ুয়াদের মতো বিদ্যাচক্র স্কুলে ক্লাস করেছি। বাড়িতে ফিরে সেই পড়া নিজের চেষ্টায় ব্রেইল পদ্ধতিতে আয়ত্ব করেছি। পরে তা ব্রেইল পদ্ধতিতেই ইন্টার পয়েন্ট ও স্টাইলাস যন্ত্রের মাধ্যমে লিখেছি। ব্রেইল পদ্ধতিতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিবেশী ভাই অমিতের সহযোগিতায় পরীক্ষা দিলাম। প্রথম দিনের পরীক্ষা ভাল হয়েছে।” |
পরীক্ষা দিচ্ছে বিশ্বপ্রিয়। ছবি: তরুণ দেবনাথ |
রায়গঞ্জের অশোকপল্লির বিশ্বপ্রিয় নার্সারি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। সেখান থেকেই ৭৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে ২০১০ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেন। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সেখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশুনা করার সুযোগ না থাকায় রায়গঞ্জ জেলা আদালতের কর্মী পরিতোষ দাস ছেলেকে রায়গঞ্জের স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করেন। সেখানেই সাধারণ পড়ুয়াদের সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে দু’বছর পড়াশোনা করেছেন তিনি। বিশ্বপ্রিয় বলেন, “বাবা নরেন্দ্রপুর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ব্রেইল পদ্ধতির সমস্ত বই ও খাতা আমাকে এনে দিয়েছিলেন। স্কুলের শিক্ষক ও তিন গৃহশিক্ষক অন্য পড়ুয়াদের মতো আমাকে বিভিন্ন বিষয়ের পড়া সাধারণ বই থেকে বুঝিয়ে দিতেন। আমি ব্রেইল পদ্ধতিতে সেই পড়া আয়ত্ত করতাম।” কলা বিভাগের ছাত্র বিশ্বপ্রিয় নরেন্দ্রপুর থাকাকালীন তবলা ও পাখোয়াজ বাজানো শিখতে শুরু করেন। তবলা শিক্ষক সুখময় চৌধুরীর কাছে তবলা শিখেছেন তিনি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় অতিরিক্ত বিষয় হিসাবে তবলায় লেটারও পেয়েছেন তিনি। তবলায় পঞ্চম বর্ষ পাশ করা বিশ্বপ্রিয় রায়গঞ্জের শিক্ষক প্রণব সরকারের কাছে তালিম নিচ্ছেন। বিশ্বপ্রিয় বলেন, “রবীন্দ্রভারতী বা বিশ্বভারতীতে তবলা নিয়ে পড়তে চাই। তবলা শিক্ষক হওয়াই আমার লক্ষ্য।” বাবা পরিতোষবাবু বলেন, “নানা রাজ্যে চিকিৎসা করিয়ে দৃষ্টি ফেরাতে পারিনি। আমি চাই, ও যা হতে চায় তাই হোক।” |