তিনি ছিলেন সিপিএম পরিচালিত ধীবর সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সারাক্ষণ তৃণমূল নেত্রীকে গালমন্দ করতেন। গ্রামে গ্রামে প্রচার করতেন সিপিএমের হয়ে। সেই ৭০ বছরের বৃদ্ধ ললিত চৌধুরী রাতারাতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ দিচ্ছেন আর বলছেন, “৩৪ বছরে সিপিএম যা করতে পারেনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েকদিনেই তা করে দেখালেন!”
এতেই থেমে থাকেননি। ঋণশোধ না-করলেও চাষের জমি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না বলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার খবর যে-সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, সেই আনন্দবাজার হাতে নিয়ে গ্রামে ঘুরে সবাইকে পড়ে শোনাচ্ছেন। বুধবারও নন্দীগ্রামে এক সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “নোটিস দিয়ে বন্ধকী জমি-সম্পত্তি নিলাম করার আইন হল একটি কালা কানুন। |
মালদহের ইংরেজবাজারের সাতটারি গ্রামে নিজের বাড়ির সামনে ললিত চৌধুরী। বুধবার মনোজ মুখোপাধ্যায়ের তোলা ছবি। |
২০০৬ সালে সিপিএমের আমলে এই আইন তৈরি হয়।” সেই আইনের গেজেট-বিজ্ঞপ্তি হাতে নিয়ে তিনি উত্তেজিত ভাবে বলেন, “এই কালা কানুন আমরা বদল করব। যারা মিথ্যে রটাচ্ছে, তারা শুধু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটায়নি, কালা কানুনও করেছে। আমি কৃষকদের জমি কাউকে দখল করতে দেব না। খেতে দিতে পারে না, কিল মারার গোঁসাই।”
মমতার ঘোষণায় ললিতবাবুরা তাই ‘বল’ পেয়েছেন। ললিতবাবুর বাড়ি মালদহ শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সাতটারি গ্রামে। তিনি মাছের ব্যবসায়ী। ২০০৬ সালে মালদহ কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে তিনি ২ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ১ লক্ষ টাকা শোধ করার পরে ঋণের বাকি টাকা ফেরত দেননি। অথচ সমবায় ব্যাঙ্কের তরফ থেকে ললিতবাবুকে ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে ঋণ পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠি পাওয়ার পরেও ললিতবাবু সমবায় ব্যাঙ্কের দরজায় পা মাড়াননি। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার ললিতবাবুর বাড়িতে বকেয়া ঋণ আদায় করতে গিয়ে পালিয়ে রেহাই পান সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ও কর্মীরা।
মালদহ কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সুমন রায় জানিয়েছেন, “পাঁচ বছর ধরে ঋণের টাকা পরিশোধ না-হওয়ায় ললিতবাবুর ঋণের টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লক্ষ টাকা। ললিতবাবুর যা সামর্থ্য, তাতে ঋণের ২ লক্ষ টাকা শোধ না-করার কোনও কারণই নেই।”
বুধবার দুপুরে সাতটারি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, ১৫ কাঠা জমির উপর ললিতবাবুর পাকা বাড়ি। তিন ছেলে। তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ঘর। তিন ছেলেই মাছের ব্যবসা করেন। রোজগেরে তিন ছেলের পাশাপাশি ললিতবাবুর ৬ বিঘা ফসলি জমি রয়েছে। যে জমি থেকে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ মণ ধান ওঠে। কখনও বা আখ চাষ করে বছরে ২০-২২ হাজার টাকা আয় হয়। শুধু তাই নয়, ফসলি জমির পাশাপাশি ৫ বিঘা আমের বাগানও রয়েছে। প্রতি বছর ২০-২৫ হাজার টাকার আম বিক্রি করেন তিনি। বেশ কিছু অত্যাধুনিক আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম তাঁর বাড়িতে রয়েছে। গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবার বলে তাঁরা পরিচিত।
তা হলে কেন ঋণের টাকা শোধ করেননি? বৃদ্ধ ললিতবাবুর জবাব, “শুটকি মাছের ব্যবসার জন্য ৫ বিঘা জমি ও ৫ বিঘা আমবাগানের কাগজ বন্ধক দিয়ে ২ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এক বছরে এক লক্ষ টাকা শোধ করি। ২০০৭ সালে শুটকি মাছ জলে ভিজে ৩ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়। সেই বছরই কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিঋণ মকুবের কথা ঘোষণার পরে আর ঋণের টাকা মেটাইনি।” ললিতবাবুর ধারণা ছিল, সমবায় ব্যাঙ্কের ঋণের টাকাও সব মকুব হয়ে গিয়েছে। সেই জন্য আর সমবায় ব্যাঙ্কেও যাননি। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় বুকে নতুন করে বল পেয়েছি।” যদিও ঘোষণার পরের দিনই সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ও দুই কর্মী তাঁর বাড়িতে এসে জানিয়ে দেন, ২৪ মার্চের মধ্যে ঋণের টাকা শোধ না করলে জমি, আমবাগান নিলাম করে দেবেন। ললিতবাবু বলেন, “আমি চেঁচামেচি শুরু করতেই সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মীরা চলে যান।” |