|
|
|
|
|
‘দ্বন্দ্ব’ উস্কে দেওয়ার
কৌশল বাম-বিজেপির
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
|
একদিকে তৃণমূলের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম দীনেশ ত্রিবেদী ‘দ্বন্দ্ব’-কে আরও উস্কে দেওয়ার চেষ্টা। অন্য দিকে মনমোহন-সরকারের মধ্যে ‘উদ্ভূত সঙ্কট’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে কংগ্রেসের সঙ্গে শরিকদের ‘দ্বন্দ্ব’ আরও বাড়ানোর চেষ্টা। রেলের যাত্রিভাড়া বৃদ্ধির বিরোধিতা করে আজ সেই কৌশলই নিল বাম-বিজেপি। দুই বিরোধী শিবিরেরই অভিযোগ, কিছু দিন আগে পণ্য পরিবহণে মাসুল বাড়িয়েছেন দীনেশ। এ বার যাত্রিভাড়া বাড়ানোর ফলে আমজনতার উপরেই বোঝা চাপবে। কিন্তু ভাড়া বৃদ্ধির বিরোধিতার থেকেও মনমোহন-সরকার ও তৃণমূলের মধ্যেকার ‘সঙ্কট’ উস্কে দিতে বেশি উৎসাহিত ছিলেন বিজেপি ও বাম সাংসদরা। স্বাভাবিক ভাবেই এ ব্যাপারে বেশি সক্রিয় ছিলেন বাম নেতারা। বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে মনমোহন-সরকারের ‘কর্তৃত্ব’ নিয়ে।
সীতারাম ইয়েচুরির অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির ভাষণ থেকে রেল বাজেটে ভাড়া বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই তৃণমূল আড়ালে এক রকম, প্রকাশ্যে অন্য রকম অবস্থান নিচ্ছে। মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা অনুমোদন করেছে। মন্ত্রিসভার শরিক হয়েও তৃণমূল আবার তাতেই সংশোধনী আনতে চাইছে! গুরুদাসের প্রশ্ন, মমতা যদি রেলের ভাড়া বাড়াতে না চান, সে ক্ষেত্রে তাঁর বিকল্প নীতিটা কী?
সেটা কেন তিনি বলছেন না?
বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদের যুক্তি, মনমোহন-সরকারের রেলমন্ত্রী বাজেটে যে কথা ঘোষণা করছেন, শরিক দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা প্রত্যাহারের কথা বলছেন! এ থেকে স্পষ্ট, মনমোহন-সরকার কর্তৃত্ব হারিয়েছে। দলের নেতাদের যুক্তি, মনমোহন-মন্টেকদের পথ ধরেই দীনেশ বাজেট করেছেন। বাজেটের ঠিক আগেই পণ্য মাশুল বাড়িয়েছেন। আর আজ ‘পয়সা’র নিরিখে ভাড়া বাড়ানোর কথা বললেও আসলে আম-আদমির ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে রেলমন্ত্রী কোটি কোটি টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন। একই অভিযোগ বাম নেতাদেরও।
জেটলি-ইয়েচুরিদের অভিযোগ, এ বারের রেল বাজেট সব থেকে ‘অসৎ’ বাজেট। পণ্য মাশুল বাড়ানো হয়েছে বাজেটের ঠিক আগেই। ফলে খাদ্যশস্য, সার, সিমেন্ট, কয়লা ও পেট্রোপণ্যের দামের উপর প্রভাব পড়বে। বাজেটে এই ঘোষণা না করে ঘুরপথে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে সরকার। আর আজ বাজেটে রেলমন্ত্রী ‘সামান্য’ ভাড়া বাড়ানোর কথা বললেও দেখা যাচ্ছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে ১০-১২ শতাংশ বাড়তি চাপ বাড়বে। কিন্তু স্লিপার ও সাধারণ শ্রেণির যাত্রীদের উপরে ১৬-২০ শতাংশ বোঝা চাপবে।
বামেরা মনে করছেন, আজকের রেল বাজেট সামগ্রিক ভাবে বেসরকারিকরণের পথে হেঁটেছে। গুরুদাস দাশগুপ্তর প্রশ্ন, “যদি রেলের ভাড়া ঠিক করার জন্য স্বাধীন সংস্থা তৈরি হয়, বেসরকারি সংস্থা খাবার পরিবেশন করে, তা হলে রেল বোর্ড কী করবে? দীনেশ তো রেল মন্ত্রক তুলে দেওয়ার কথা বলছেন!” ইয়েচুরি ও গুরুদাস দু’জনেই আজ মার্গারেট থ্যাচারের প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাঁদের যুক্তি, থ্যাচারের নীতি মেনে ইংল্যান্ডে রেলের বেসরকারিকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার রেলের জাতীয়করণ করতে হয়েছে।
রেলের আর্থিক হাল যেখানে এতটাই খারাপ, সেখানে পৃথক রেল বাজেট করার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী নেতারা। বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, রেলের অসম্পূর্ণ প্রকল্পগুলি শেষ করতে এক লক্ষ কোটি টাকা প্রয়োজন। ২৩৬টি আদর্শ স্টেশন গত বার ঘোষণা করা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ৯টি! কাঁচরাপাড়ার রেল কোচ কারাখানার কাজও দেরিতে হচ্ছে। বিরোধীদের যুক্তি, এক সময় রেল ছিল সরকারের সবথেকে বড় আয়ের উৎস। সেই কারণেই পৃথক রেল বাজেট করা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, রেলই অর্থ মন্ত্রকের সাহায্য বা ‘গ্রস বাজেটারি সাপোর্ট’-এর মুখাপেক্ষী!
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হা বলেন, “অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়িত করার টাকা আসবে কোথা থেকে, তার উপায় বলা হয়নি। অপারেটিং রেশিও এক বছরে প্রায় দশ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কোন পথে তা সম্ভব হবে, তার কোনও দিশা নেই বাজেটে।” কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে ইয়েচুরির মন্তব্য, “রেলে প্রায় দু’লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। সেটাই পুরোপুরি পূরণ হচ্ছে না। অর্থাৎ নতুন কোনও পদ তৈরি হচ্ছে না।”
রেলে খাবার পরিবেশনের জন্য বিশ্বব্যাপী দরপত্র দেওয়ার প্রস্তাবও ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বিরোধী নেতারা। যশবন্তের প্রশ্ন, “তা হলে কি বিদেশি সংস্থা এ বারে রসগোল্লা এবং বড়াপাও খাওয়াবে?”
রেল বাজেটের সমালোচনা করে সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “যাত্রী ভাড়া বাড়লেও যাত্রী পরিষেবা ও স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করা হয়েছে। যাত্রী সুরক্ষাও উপেক্ষিত।” রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “রেলমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ কী, তা রেলমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই জানেন না! রেলমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ভারতীয় রেলকে আইসিইউ থেকে বার করেছেন। কিন্তু কে আইসিইউ-তে পাঠিয়ে ছিলেন, তা বলার সাহস দেখাতে পারেননি। আইসিইউ থেকে রেলকে বার করা এবং ঢোকানোর ব্যাপারে রেলমন্ত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে লড়াই চলছে!”
সূর্যবাবুর মতে, “রেলের ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে রেলমন্ত্রী তাঁর নেত্রীর অনুমোদন নেননি, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, এর আগে তিন বার রেলের পণ্য মাসুল বেড়েছে। তৃণমূলনেত্রী তার কোনও প্রতিবাদ করেননি।” তবে রেল বাজেটকে সমর্থন জানিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “এই বাজেটে উন্নয়নের দিশা আছে।” |
|
|
|
|
|