|
|
|
|
|
দীনেশের দিকে ঘুরেও
তাকালেন না সুদীপরা
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
|
নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী থাকল সংসদ। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনে টানটান হয়ে থাকল রাজধানীর রাজনৈতিক মঞ্চ।
রেল বাজেট পেশের ঠিক পর সংসদের দোতলার ৬১ নম্বর ঘরে সাংবাদিক সম্মেলন করে ভাড়া বাড়ানোর গুণাগুণ ব্যাখ্যা করছেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী! আর ঠিক সেই সময়েই এক তলায় সমান্তরাল ভাবে চলছে তাঁর দলেরই অন্য এক সাংবাদিক সম্মেলন! যেখানে দীনেশের দলের সতীর্থ নেতা-সাংসদরাই ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন রেল বাজেটের সমালোচনায়।
দোতলায় রেলমন্ত্রী বোঝাচ্ছেন, কী ভাবে ‘গত দু’বছরে আইসিইউ’-তে ঢুকে যাওয়া ভারতীয় রেলকে তিনি বাঁচিয়েছেন! এক তলায়, লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বৈদ্যুতিন চ্যানেলকে বলে চলেছেন, ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে রেলমন্ত্রীকে। সুদীপবাবুর কাছে কলকাতা থেকে মুহুর্মুহু ফোন আসছে। যার নির্যাস, রেল বাজেট নিয়ে ঘোর অসন্তুষ্ট তৃণমূল নেত্রী। সুদীপকে বলা হচ্ছে হয় ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন দীনেশ, নয়তো সরে যান।
অথচ আজ সকালে ‘মা মাটি মানুষের’ নাম নিয়েই বাজেট বক্তৃতা শুরু করেছিলেন দীনেশ। বাংলায় বলেছিলেন, “মা মাটি মানুষকে আমার শ্রদ্ধা এবং প্রণাম জানাই।” রাজ্যসভা থেকে তাঁর বক্তৃতা শুনতে গ্যালারিতে তখন হাজির ডেরেক ও’ব্রায়ান, সুখেন্দুশেখর রায়। অথচ গোটা বক্তৃতাটি পড়ার সময় কখনও কংগ্রেস, কখনও বা অন্য শরিক সাংসদদের প্রশংসাসূচক ভাবে টেবিল চাপড়াতে দেখা গেলেও তৃণমূলের বেঞ্চ ছিল অপেক্ষাকৃত চুপচাপ।
বক্তৃতা শেষে রেলমন্ত্রী গিয়ে হাত মেলালেন প্রধানমন্ত্রী, ডিএমকে নেতা টি আর বালু, এমনকী বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও। পিঠ চাপড়ে তাঁকে উৎসাহ দিলেন সুষমা স্বরাজ। কিন্তু দূরত্ব রয়ে গেল সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, সুব্রত বক্সী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। দীনেশ যখন অভিনন্দন সংগ্রহে ব্যস্ত, সুদীপরা যে শুধু ঘুরে তাকালেন না তা-ই নয়, সংসদীয় বেঞ্চে বসেই (অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যাওয়ার পর) রীতিমতো আপৎকালীন বৈঠক শুরু হয়ে গেল তৃণমূলী নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে। সাম্প্রতিক অতীতে নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ যাদব বা খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেল বাজেট পেশের পরে যে চিত্রটি অকল্পনীয় ছিল, সেটাই দেখা গেল আজ সতীর্থ নেতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের বদলে এক অচিরাচরিত থমথমে ভাব।
দুপুর দু’টোর পরে সেই থমথমে ভাবই আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ল তৃণমূল শিবিরে। সর্বাগ্রে টুইট করে ডেরেক জানালেন, দীনেশের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর ‘জুতোয় পা গলাতে’ ডেরেক রাজি নন। লোকসভার পর রাজ্যসভায় বাজেট পেশ করে দীনেশ তাঁর ঘরে এলেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত শুধুই রেলের অফিসাররা। একটু পরেই অবশ্য সুদীপ, সুব্রত বক্সী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা এলেন। কিন্তু রেলমন্ত্রীর ঘরে নয়। পাশে অতিরিক্ত ব্যক্তিগত সচিব রতন মুখোপাধ্যায়ের ঘরটি তখন কার্যত ‘ওয়ার রুম’। কারণ ভাড়া বাড়ার কথা শুনে সেখানেই ফোনে যোগাযোগ করেছেন তৃণমূল নেত্রী। কথা বলতে চেয়েছেন সুদীপবাবুর সঙ্গে। দীর্ঘক্ষণ নেত্রীর সঙ্গে কথা বললেন সুদীপবাবু। উত্তেজনার পারদ তখন ক্রমশ ঊধ্বর্মুখী। মমতার সঙ্গে কথা বলার পর রেলমন্ত্রীর সঙ্গে মিনিট পাঁচেক রুদ্ধদ্বার বৈঠক সারলেন সুদীপবাবুরা। আর তার পরেই দু’টি স্পষ্ট শিবিরে ভাগ হয়ে গেল তৃণমূলের সংসদীয় দল। এক দিকে একা রেলমন্ত্রী। অন্য দিকে সুদীপ, সুব্রত বক্সী-সহ বাকি নেতা ও মন্ত্রীরা। সুদীপের কথায়, “যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন, তাঁরাই বুঝবেন, সাধারণ মানুষের উপর চাপ তৈরি করা তাঁর দর্শনের মধ্যে পড়ে না। রেলমন্ত্রী যা করেছেন নিজের সিদ্ধান্তে করেছেন। দলের মত না নিয়েই।”
অন্য দিকে নিজের দুর্গ বাঁচানোর জন্য একা লড়ে গেলেন দীনেশ। সংসদের সাংবাদিক সম্মেলনে, সংসদ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে, কখনও বা বৈদ্যুতিন চ্যানেলে। ‘দলের আগে দেশ তথা ভারতীয় রেল’ এই আপ্তবাক্যটিকে ব্যবহার করলেন কখনও ঢাল কখনও তরোয়ালের মতো। এ কথাও বলতে ছাড়লেন না, যদি দেশের সেবা করার জন্য তাঁর কুর্সি যায়, তা নিয়েও তিনি ভাবিত নন। কারণ, “দেশের জন্য ভগৎ সিংহ তাঁর জীবনই দিয়েছিলেন। আর আমি সামান্য চেয়ার ছাড়তে পারব না!”
আজকের বাজেট বক্তৃতায় অজস্র শের-শায়রি শুনিয়েছেন রেলমন্ত্রী। যার সর্বশেষটি ছিল ‘রেলগাড়ি কা ছুকছুক মে হি/ আম আদমি কা ধকধক হ্যায়।’ অথচ নিয়তির পরিহাসের মতো এই ‘আম আদমির ধকধক’কে গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগেই তাঁর রেলমন্ত্রিত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল। |
|
|
|
|
|