নেত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও ভাড়া
বাড়িয়ে ডেকে আনলেন বিপদ

প্রায় এক দশকের মাথায় রাজনীতির চেনা ‘ছক’ ভেঙে যাত্রিভাড়া বাড়ানোর সাহস দেখান দীনেশ ত্রিবেদী। আজ বাজেটে যাত্রিভাড়ায় কিলোমিটার প্রতি দুই থেকে ত্রিশ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব দেন তিনি। যদিও একমাত্র সে কারণেই তাঁকে নেত্রীর কোপে পড়তে হয়। এবং বিদায়ের পথও পরিষ্কার হয়।
দীনেশ যে প্রস্তাব করেছেন এ দিন, শেষ পর্যন্ত তা বজায় থাকবে এবং সংসদে পাশ হবে, নাকি দীনেশের পরবর্তী মন্ত্রী এসে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে নেবেন, তা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে রেল মন্ত্রক থেকে রাজনীতির কারবারিরা প্রায় সকলেই একটা কথা বললেন এ দিন: জনপ্রিয়তার মোহে নীতীশ কুমার, লালু প্রসাদ বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ন’বছর ধরে যা করতে পারেননি, সেটাই করে দেখালেন দীনেশ। কখন করলেন? যখন বারবার তাঁর দলনেত্রী ভাড়া বাড়ানোর বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছেন। কেন করলেন? দীনেশের সাফ জবাব, “রেল আইসিইউ-তে চলে গিয়েছে। তাই আয় বাড়াতে ভাড়া বৃদ্ধি করা ছাড়া উপায় ছিল না।” যার পাল্টা হিসেবে নন্দীগ্রামের এক অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “আমরা জানতাম না ভাড়া বাড়ছে।” তিনি এমনকী প্রতিশ্রুতি দেন, “সাধারণ মানুষের জন্য ভাড়া বাড়াতে দেব না। আপনাদের আশ্বস্ত করলাম।”
অথচ, বেতন কমিশন, আর্থিক মন্দা, দৈনন্দিন রেল চালাতে প্রয়োজনীয় ডিজেল-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, যাত্রিভাড়া বাবদ আয় কমে যাওয়া সব মিলিয়ে দীনেশের বাজেটে আজ কার্যত রেলের ক্ষয়িষ্ণু চেহারাটা বারবার ফুটে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী দিনে আয় বাড়াতে দীনেশের সামনে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রেলের আয় যে কমছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন দীনেশও। বাজেট নথি বলছে, মুনাফা তো হয়ইনি, উল্টে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপারেটিং রেশিও-র লক্ষ্যমাত্রা ৯১.১% ধার্য করলেও এখন রেলের ১০০ টাকা আয় করতে খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা। এই রেশিও কিন্তু রাতারাতি এ জায়গায় পৌঁছয়নি। দীর্ঘদিন যাত্রিভাড়া না বাড়ায় এবং ক্রমাগত সব ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে চলায় গত কয়েক বছরে অপারেটিং রেশিও বেশ কয়েক ধাপ বেড়ে গিয়েছে।
যাত্রিভাড়া বাড়লে কতটা লাভ হবে রেলের? আজ রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তলের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, এর ফলে রেলের ঘরে আগামী এক বছরে সাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকা আসবে। একই সঙ্গে আগামী দিনে যাতে ডিজেলের দাম বাড়লে সেই অনুপাতে যাত্রিভাড়া বাড়ানো যায়, সেই রাস্তায় খোলা রেখেছিলেন দীনেশ। পেট্রোলের দাম যে ভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়েছে, সে ভাবে রেলে যাত্রিভাড়ার ক্ষেত্রেও একটি স্বাধীন ‘ট্র্যাফিক রেগুলারিটি অথরিটি’ গড়ার কথা ঘোষণা করেন তিনি। বলা হয়, এই কর্তৃপক্ষের কাজ হবে বাজারের চাহিদা মেনে রেলের ভাড়া ঠিক করা। এই নীতি মানা হলে কেবল মাত্র বাজেটের সময় যাত্রিভাড়া বৃদ্ধির যে রীতি রয়েছে, তা-ও ভবিষ্যতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে মনে করছে রেল মন্ত্রক।
চাহিদা মতো কেন্দ্রীয় সাহায্য না পাওয়া, পিপিপি মডেলের আশানুরূপ ফল না পাওয়া, আয় কমে যাওয়া এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাঁর যে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না, তা আজ স্বীকার করে নেন দীনেশ। তাঁর কথায়, “রেলের কাঁধ ঝুলে গিয়েছে। তাই মন্ত্রকের ভালর জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিল, নিয়েছি।” তবে শীর্ণকায় রেলের আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখতে রেলমন্ত্রীর নেওয়া এই সাহসী বাজেটকে স্বাগত জানায় বণিকমহলের একাংশ। বাজেটের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী দফতর। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এই বাজেটকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন।
দীনেশ আজ যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে আমআদমির লোকাল ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণিতে (মূলত শহরতলি ও অন্যান্য) প্রতি কিলোমিটারে দুই পয়সা ভাড়া বাড়ছে। দূরপাল্লার ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণিতে কিলোমিটার প্রতি তিন পয়সা, স্লিপারে ৫ পয়সা এবং বাতানুকূল চেয়ার কার ও তৃতীয় শ্রেণিতে ১০ পয়সা, দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণিতে যথাক্রমে পনেরো ও ত্রিশ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেন রেলমন্ত্রী। মন্ত্রকের পক্ষ থেকে আগামী দিনে সমস্ত ভাড়া পাঁচের গুণিতক করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। দীনেশ যুক্তি দেন, “নতুন বিন্যাসের পরে যদি ভাড়া বেড়ে ১১ বা ১৬ টাকা হয় তা হলে যাত্রীকে প্রকৃতপক্ষে ১০ বা ১৫ টাকা দিতে হবে।” কিন্তু ভাড়া যদি ১২ বা ১৭ টাকা হয় তা হলে যাত্রীকে দিতে হবে যথাক্রমে ১৫ এবং ২০ টাকা। খুচরোর অভাবের কারণে রেল মন্ত্রক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান যুক্তি দিলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুকৌশলী এই পদক্ষেপে যাত্রীর অজান্তেই পকেট থেকে টাকা গলে যাবে। অতিরিক্ত অর্থ আসবে রেলের ঘরে। প্ল্যাটফর্ম-সহ সমস্ত টিকিটের ন্যূনতম দাম এখন থেকে বেড়ে পাঁচ টাকা করারও প্রস্তাব দেন দীনেশ।
অথচ, মমতা তথা তৃণমূলের এ যাবৎ নীতিই হল, মানুষের উপর বাড়তি বোঝা চাপে, এমন সিদ্ধান্ত না নেওয়া। কিন্তু আজ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে যাত্রিভাড়া বৃদ্ধির মতো যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, তার পক্ষে দীনেশের যুক্তি, তিনি জোর দিয়েছেন মূলত তিনটি বিষয়ে। যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষা, রেলের সার্বিক পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও যাত্রী নিরাপত্তা। দীনেশের কথায়, খাবার থেকে শুরু করে শৌচাগার, প্রচুর অভিযোগ আছে রেলের বিরুদ্ধে। মন্ত্রক বলছে, সেই কারণে যাত্রিভাড়া থেকে যে অতিরিক্ত টাকা আসবে, তার একটি বড় অংশ এই ক্ষেত্রগুলির উন্নতিতে ব্যবহার করা হবে। তাই ট্রেনে খাবারের মান বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের ঘোষণা করা ছাড়াও, প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিটি দূরপাল্লার ট্রেনে একটি করে কোচ, দেশের ৩২১টি স্টেশনে চলমান সিঁড়ি, গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে বাতানুকূল লাউঞ্জ, ২৫০০ কামরায় গ্রিন টয়লেট বসানোর কথা জানিয়েছেন দীনেশ।
যাত্রী পরিষেবার সঙ্গে সুরক্ষা খাতেও এ বার প্রায় দু’হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থ বিনিয়োগ করছে মন্ত্রক। রেলের সুরক্ষাব্যবস্থা সার্বিক ভাবে খতিয়ে দেখতে রেলওয়ে সেফটি অথরিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা স্বাধীন ভাবে কাজ করবে। দেশের ২০২টি স্টেশনে সুসংহত নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এ বারের রেল বাজেটে। পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১৯ হাজার কিলোমিটার লাইনে খোলনলচে বদলে ফেলার পরিকল্পনা আছে। ফলে ওই লাইন দিয়ে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হয়। এই কাজের জন্য ৬,৪৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে।
বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়লেও রেলের যে ভাঁড়ে মা ভবানী দশা, সেটা বাজেটে আর্থিক হিসাবনিকেশের বিস্তারিত খতিয়ানই বলে দিচ্ছে। যাত্রী পরিবহণে আয় কমেছে ১৬৫৬ কোটি টাকা। অন্যান্য খাতে আয় কমেছে ৩৬০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২১৬৯ কোটি টাকা। টাকা না থাকায় সুরক্ষা ক্ষেত্রে আপৎকালীন কাজের জন্য অর্থ মন্ত্রকের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ধার নিতে হয় মন্ত্রককে। যে টাকা চলতি আর্থিক বছরে সুদে-আসলে মিটিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন দীনেশ। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে রেল কর্তাদেরই সংশয় রয়েছে। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী (২০১২-১৭) পরিকল্পনায় রেল মন্ত্রক সব মিলিয়ে ৭ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই টাকার মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি কেন্দ্রীয় সাহায্য হিসাবে আসবে বলে আশাবাদী মন্ত্রক। সেই অনুপাত বজায় রেখে এ বছরে রেল মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ৪৪ হাজার কোটি টাকা বাজেট সাহায্য চাওয়া হয়। যদিও মাত্র ২৪ হাজার কোটি টাকা সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রণববাবু। তার মধ্যে আবার চার হাজার কোটি টাকা চলে যাবে জম্মু-কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রেলের জাতীয় প্রকল্পগুলিতে। তারই মধ্যে এ যাবৎ রেলের সর্ববৃহৎ বার্ষিক যোজনা তৈরি করেছেন দীনেশ। যার পরিমাণ ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.