দীনেশের বদলে মুকুলকে চেয়ে চিঠি মমতার
সরকারের সঙ্কট কাটাতে
দাবি মানলেন মনমোহন

জীবনের প্রথম রেল বাজেট পেশ করেই বিদায় নিতে হচ্ছে দীনেশ ত্রিবেদীকে।
তাঁর আপত্তি উপেক্ষা করে যাত্রিভাড়া বাড়ানোয় দীনেশকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি নতুন রেলমন্ত্রী হিসেবে মুকুল রায়ের নাম প্রস্তাব করেছেন তিনি। দীনেশ শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেবেন বলে খবর।
আজ সন্ধ্যায় ফ্যাক্স মারফৎ মমতার চিঠি পেয়েই সরকারের মুশকিল আসান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, “মমতাকে বোঝান, উনি যেন কিছু দিন অপেক্ষা করেন।” এর পর মমতাকে ফোন করেন প্রণববাবু। কিন্তু মমতা অপেক্ষা করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে বলুন এখনই দীনেশকে বরখাস্ত করার পরামর্শ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দিতে।” তখন প্রণববাবু মমতাকে ১৬ তারিখ তিনি কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ না-করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করেন। তাতে রাজি হলেও মমতা স্পষ্টই বলেছেন, তার পরেই নতুন রেলমন্ত্রী এসে ভাড়াবৃদ্ধি প্রত্যাহারের প্রস্তাব সংসদে পেশ করবেন।
দীনেশ যে রেলের ভাড়া বাড়াবেন, মমতা তা জানতেন না। আজ তিনি নন্দীগ্রাম গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পথে জানতে পারেন, রেলের ভাড়া সর্বস্তরে বাড়ানো হয়েছে। খবর পেয়েই ক্ষুব্ধ দলনেত্রী ফোন করেন তৃণমূলের সংসদীয় দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সুদীপ মারফৎ দীনেশকে জানানো হয়, “অবিলম্বে রেলের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন। তা না-হলে ইস্তফা দিন।” এর পরেই সুদীপ সংসদ ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের জানান, এই ভাড়াবৃদ্ধি তৃণমূল মানছে না। আর তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই মমতা নন্দীগ্রামে তাঁর জনসভায় বলেন, রেলের ভাড়া বাড়তে দেওয়া হবে না।
দীনেশ অবশ্য নিজের অবস্থানেই অনড় থাকেন। সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দেন, তিনি মমতার সঙ্গে কথা বলে রেল বাজেট করেননি। রেল বাজেট এতটাই গোপন বিষয় যে তিনি সেটা প্রধানমন্ত্রীকেও দেখাননি। এবং ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তিনি কোনও অবস্থাতেই প্রত্যাহার করবেন না। বরং নেত্রী চাইলে তিনি ইস্তফা দিতে রাজি।
রেল নিয়ে সঙ্কটের মধ্যে কংগ্রেসের চিন্তা বাড়িয়ে বেসুরে গাইতে শুরু করেছে আর এক শরিক ডিএমকে-ও। তাদের দাবি, শ্রীলঙ্কায় তামিল নির্যাতন নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাব সমর্থন করতে হবে ভারতকে। দুই শরিকের এই চাপমুক্তির উপায় খুঁজতে রাতে নিজের বাসভবনে জরুরি বৈঠকে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী। আসরে নেমেছেন প্রণববাবু, সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। মমতার সঙ্গে প্রণববাবুর কথা হয়। মুকুল রায়ের সঙ্গে কথা বলেন প্রণব-আহমেদ। কংগ্রেসের একটি অংশের প্রস্তাব, দীনেশকে রেলমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে এবং ভাড়াবৃদ্ধি আংশিক প্রত্যাহার করে অবস্থা সামলানো হোক।
কিন্তু ঘটনা হল, সেটা করার ক্ষেত্রেও অসুবিধা রয়েছে। এটা ঠিক যে মমতা এখনই ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে চাইছেন না। কিন্তু একই সঙ্গে ভাড়াবৃদ্ধি আংশিক প্রত্যাহারের প্রস্তাবেও এখনও পর্যন্ত তিনি রাজি নন। আবার কংগ্রেস যদি দীনেশের বদলে তৃণমূলের অন্য কাউকে রেলমন্ত্রী করে, তা হলে তাঁর পক্ষেও একার সিদ্ধান্তে ভাড়াবৃদ্ধি প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। কারণ, আজ সকালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পরে রেল বাজেট লোকসভায় পেশ হয়ে গিয়েছে।
বিজেপি-র প্রবীণ নেতা, লালকৃষ্ণ আডবাণী আজ বলেন, “রেল বাজেট এখন সংসদের সম্পত্তি। এটা সরকারের বাজেটও বটে। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়। যদি ভাড়াবৃদ্ধি প্রত্যাহার করতে হয়, তা হলে সেটা সরকারকে করতে হবে। এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দীনেশ ত্রিবেদীর দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়।” বস্তুত, বিজেপি এখন সরকারকে চেপে ধরার সুযোগের অপেক্ষায়। মুখে ভাড়াবৃদ্ধির বিরোধিতা করলেও মনে মনে তারা চাইছে, সরকার এ ব্যাপারে কড়া অবস্থান নিক। তা হলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হবে।
অবস্থা যদি এমন হয় যে, দীনেশের বদলে তৃণমূলের অন্য কাউকে রেলমন্ত্রী করার প্রস্তাব সরকার মেনে নিল অথচ ভাড়াবৃদ্ধি পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি মানল না, তা হলে সঙ্কট আরও গভীর হবে। তখন সংসদে দাঁড়িয়ে নিজের দলের মন্ত্রী আনা বাজেটেরই বিরোধিতা করতে হবে তৃণমূল সাংসদদের। আর তৃণমূল সমর্থন না-করলে বাজেট পাশ হওয়া কঠিন। সেটা স্বাভাবিক ভাবেই চান না কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাতে ইতিমধ্যেই কোণঠাসা সরকারের সঙ্কট আরও বাড়বে। এমনকী সরকার পড়েও যেতে পারে। বিজেপি ঠিক সেটাই চাইছে। এখন ‘রেলমন্ত্রী’ কে জানতে চেয়ে আগামিকাল সংসদে মুলতুবি প্রস্তাব এনেছে তারা। একই প্রশ্নে মুলতুবি প্রস্তাব এনেছে বামেরাও।
এ হেন জটিল পরিস্থিতিতেও কংগ্রেসি মন্ত্রীদের একাংশ কিন্তু মমতার সব দাবি মেনে নিয়ে সমঝোতা করার বিরোধী। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভাড়াবৃদ্ধি প্রত্যাহারের প্রস্তাব এলে বিরোধিতা করার কথা বলছেন তাঁরা। ওই মন্ত্রীদের বক্তব্য, মমতা যদি আংশিক ভাড়াবৃদ্ধিতে রাজি না-হন এবং সরকার তাঁর দাবি মেনে নেয়, তা হলে গোটা দেশে বার্তা যাবে যে সরকার শরিকদের হাতের পুতুল। তাতেও তো সরকার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁদের প্রস্তাব, মুলায়মকে সরকারে এনে এই সঙ্কট কাটানো হোক। কিন্তু কংগ্রেসের অন্য অংশের মতে, সরকারের এখন শিয়রে সঙ্কট। প্রথমত রাষ্ট্রপতির বক্তৃতার উপরে শরিকদের সংশোধনী নিয়ে তারা জেরবার। সেই জন্য গত কাল প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে সংশোধনী না-আনার জন্য অনুরোধ করতে হয়েছে প্রণববাবুকে। লোকসভায় তৃণমূলের আনা সংশোধনী টেকনিক্যাল কারণে খারিজ হয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের অসন্তোষ যাতে বাজেট অধিবেশনের উপরে প্রভাব না-ফেলে সে জন্য আগামিকাল অন্যান্য সংশোধনীর উপরে ভোটাভুটির আগে জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করবেন প্রধানমন্ত্রী।
এই পরিস্থিতিতে রেল বাজেট নিয়ে বেশি ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। কাল বাদ পরশু কেন্দ্রীয় বাজেট। এমনিতেই তার আগে রাজ্যের দাবিদাওয়া নিয়ে সংসদ চত্বরে ধর্নায় বসছে তৃণমূল। এর পর মমতা আরও বেঁকে বসলে বাজেট অধিবেশনের উপরেই প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়ে যাবে। যার অর্থ, সরকারের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় তৈরি হওয়া। দল ও সরকারের এই অংশের মতে, মুলায়মকে পাশে নিয়ে এখনই এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তাই মমতাকে সন্তুষ্ট করাই আশু লক্ষ্য। ভাড়াবৃদ্ধি নিয়ে বিরোধ এমন পরিস্থিতি তৈরি করল ঠিকই, কিন্তু দীনেশকে ইস্তফা দিতে বলাটাকে মোটেই আকস্মিক হিসেবে দেখছেন না তৃণমূল নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, আজ হোক বা কাল, দীনেশকে যেতেই হত। তাঁর ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই জলঘোলা হচ্ছিল দলের অন্দরে। মমতাও যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিছু দিন আগে দীনেশ বলেছিলেন, তাঁর কাছে রেলের স্বার্থ আগে, পরে দলের। তাতে তৃণমূল সাংসদেরা অসন্তুষ্ট হন। এর পর অন্তর্বর্তী নির্বাচন নিয়েও দীনেশের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জলঘোলা হয়। মমতার নির্দেশে সেই বিবৃতি নিয়েও পিছু হঠতে হয়েছিল দীনেশকে। মমতার কাছে তিনি দুঃখপ্রকাশও করেন।
মাস দুয়েক আগে মমতার সঙ্গে দেখা করে দীনেশ রেলভাড়া বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মমতা তখনই তাঁকে বলে দিয়েছিলেন, ভাড়া বাড়ানো যাবে না। প্রধানমন্ত্রী, প্রণববাবু, মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া, স্যাম পিত্রোদা প্রমুখ দীনেশের উপর চাপ দিতে থাকেন ভাড়া বাড়ানোর জন্য। রেলের ভাড়া শেষ বেড়েছিল ২০০২ সালে, নীতীশ কুমারের আমলে। তার পরে কয়লা-তেলের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। সরকারের শীর্ষ নেতাদের যুক্তি ছিল, রেলের ভাড়া না বাড়ালে দেশের সার্বিক আর্থিক স্বাস্থ্য আরও বেহাল হবে।
এক দিকে জনমোহিনী রাজনীতি, অন্য দিকে সংস্কারের দাবি। কিছু দিন ধরেই টানাপোড়েনের মধ্যে ছিলেন দীনেশ। শেষে সিদ্ধান্ত নেন, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর পরামর্শই তিনি মানবেন। আজ বাজেট বক্তৃতার শুরুতে সনিয়ার কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন দীনেশ। বাজেট পেশের পর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে টুইট করে প্রশংসা করা হয়েছে। প্রশংসা করেছেন প্রণববাবুও। ফলে দীনেশের বাজেট কংগ্রেসের কথায় করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে তৃণমূল শিবিরে সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে।
আবার মমতার যুক্তি হল, তৃণমূল চেয়েছে বলেই দীনেশ রেলমন্ত্রী। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে কথা না বলে কি কখনও প্রণববাবু বাজেট পেশ করেন? কংগ্রেসের ইস্তাহারে যে সব সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাজেটে ঘোষণা করা হয়। কমিউনিস্টরাও চিরকাল তাদের মতাদর্শগত অবস্থান থেকেই বাজেট করে। সুতরাং পেট্রোপণ্যের দাম বাড়লে বিরোধিতা করা হবে, অথচ তৃণমূলেরই মন্ত্রী রেলের ভাড়া বাড়াবেন, এটা স্ববিরোধী হয়ে যায়। তাই আজ সিপিএম এবং বিজেপি দুই বিরোধী পক্ষই যখন ভাড়া বাড়ানোর নিন্দায় মুখর, তখন তৃণমূল নেত্রী সিদ্ধান্ত নেন দীনেশকে সরতে হবে। তা না হলে পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রাম বাংলায় সিপিএম আরও বড় প্রচার করবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিক ভাবেই মমতার পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.