পুঁজির পরিমাণ সামান্যই। তা থেকেই গ্রামের কৃষকদের ঋণ দিয়ে গত কয়েক বছরে একই সঙ্গে ছোট-মাঝারি চাষিদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিল রাজ্যের বিভিন্ন সমবায় ব্যাঙ্কগুলি। পাশাপাশি কর্ম সংস্থানের সুযোগ খুঁজে পেয়েছিলেন গ্রামীণ মানুষ।
মহাজনি প্রথা কিংবা চড়া সুদে চাষিদের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করে অসময়ে তাঁদের বন্ধু হয়ে ওঠা এই সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ঋণ আদায়ের সুযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলে শুধু স্বল্প পুঁজির ওই ব্যাঙ্কগুলিতে ‘লালবাতি’ জ্বলবে না, অসময়ে ঋণ না পেয়ে ঘোর সমস্যায় পড়বেন ছোট চাষিরাও। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও নদিয়া-মুর্শিদাবাদ দুই জেলার সমবায় কর্মী থেকে ছোট-মাঝারি চাষিদের অধিকাংশের এমনই ধারণা।
১৯৯৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ৩১ মার্চ, ১০ বছরের কৃষি ঋণ সরকার মকুব করেছে। ফলে ‘মুর্শিদাবাদ জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক লিমিটেড-এর অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকা। যে টাকা আদৌ আর ব্যাঙ্কের ঘরে ফিরবে কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। “ওই টাকা না ফিরলে পরবর্তীকালে চাষিদের ঋণ দেব কী করে?” প্রশ্ন ব্যাঙ্ক কর্তাদের।
ছবিটা অন্যত্রওও একই। ৩৮৪টি প্রাথমিক ঋণদান সমবায় সমিতির মাধ্যমে ৩৮ হাজার ৩৭২ জন কৃষককে চাষ আবাদের জন্য গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরেই ৭৪ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা স্বল্প মেয়াদি (৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে পরিশোধ যোগ্য) ঋণ দেওয়া হয়েছিল। তার সবটাই এখন অনাদায়ী। এ ছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলার স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির প্রায় এক লক্ষ মহিলা সদস্যকে ২৬ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে। দু-বছর মেয়াদি ওই ঋণের সবটাই এখন অনাদায়ী।
মুর্শিদাবাদ জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক লিমিটেড-এর ডেভলপমেন্ট অফিসার সমরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “অনাদায়ী ঋণ পরিশোধ করার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নির্দেশিত পদ্ধতি প্রয়োগ করে ঋণ গ্রহীতাদের কাছে প্রথমে পাঠানে হয় সাদা নোটিশ। তার পর পর্যায়ক্রমে লাল নোটিশ। তাতেও কাজ না হলে মামলা করা হয়। শেষ ধাপ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। তার ফলে গ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ শোধের জন্য চাপ তৈরি হয়।” অনাদায়ী ঋণের টাকা ফেরত পেতে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না বলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর ওই চাপ থেকে ঋণ গ্রহীতারা মুক্ত হয়ে গেল।
ফলে কৃষি ঋণদানের ব্যাঙ্কগুলিতে অচিরেই লালবাতি জ্বলবে বলে জানান বহরমপুর ও কান্দির ‘কৃষি ও গ্রামীন উন্নয়ন ব্যাঙ্ক’ মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক জন্মেজয় মণ্ডল ও সত্যনারায়ন প্রামাণিক। নদিয়া জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি লিমিটেড-এর পক্ষ থেকে দেওয়া কৃষি ঋণের মধ্যে চলতি আর্থিক বছরের মধ্যে আদায় হওয়ার কথা ছিল ৮২ কোটি টাকা। তার মধ্যে এখন পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৭২ কোটি টাকা। ওই ব্যাঙ্কের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক এনাসুদ্দিন অবশ্য বাকি টাকা আদায় হবে বলে মনে করেছেন। কী করে? মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার ফলে চাষিদের চাপ দেবেন কী করে? তার কোনও সদুত্তোর অবশ্য এনাসুদ্দিন দিতে পারেননি।
নদিয়া সমবায় কৃষি ও গ্রাম উন্নয়ন ব্যাঙ্ক লিমিটেড থেকে দেওয়া কৃষি ঋণের মধ্যে চলতি বছরে আদায় হওয়ার কথা ছিল ২৪ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে আদায় হয়েছে ১ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা। ওই ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান পবিত্রমোহন বিশ্বাস বলেন, “এ অবস্থায় সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে ঋণ গ্রহীতাদের কিছু কিছু ছাড় দিয়েও টাকা আদায় করতেই হবে।” কতটা সম্ভব হবে?
আপাতত সে প্রশ্নের সামনেই থমকে রয়েছে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির ভবিষ্যৎ। |
(তথ্য সূত্র: অনল আবেদিন, সুস্মিত হালদার) |