ভারতে জনগণনার সহিত গৃহস্থালির সমীক্ষাও হইয়া থাকে। ২০১১ সালের গৃহস্থালি সমীক্ষার ফলটি সম্প্রতি প্রকাশিত। গত দশ বৎসরে শহর ও গ্রামে জীবনযাত্রার মানে উন্নতি আসিয়াছে। পাকা বাড়ি, পানীয় জলের কল, বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিভিশন প্রভৃতি সকলই বাড়িয়াছে। কিন্তু উদ্বেগ বৈষম্য লইয়া। শহর ও গ্রামে বিস্তর পার্থক্য রহিয়া যাইতেছে, এবং বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে অত্যন্ত বেশি হেরফের দেখা যাইতেছে। অর্থাৎ জনগণের একটি বৃহৎ অংশের নিকট দারিদ্রমুক্তি আরও কঠিন হইয়া উঠিতেছে, কারণ তাহারা প্রতিযোগিতায় পিছাইয়া পড়িতেছে। বিদ্যুৎ-সংযোগের উদাহরণটি দেখা যাউক। শহরাঞ্চলে দশটির মধ্যে নয়টি গৃহই যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ পাইয়াছে, গ্রামাঞ্চলে সেখানে প্রায় অর্ধেক গৃহে এখনও বিদ্যুৎ নাই। শিশুদের পড়াশোনা হইতে মহিলাদের হস্তশিল্প-কুটিরশিল্পের দ্বারা রোজগার, সকলই বিদ্যুতের অভাবে আরও কঠিন হইয়া পড়ে। তাই বিদ্যুৎহীনতার জন্য গ্রামের মানুষদের আর্থিক উন্নতির সুযোগ হ্রাস পাইতেছে। কিন্তু এখানেও দক্ষিণ ভারতের গ্রামবাসীরা অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে ৯০ শতাংশ বিদ্যুদয়ন ঘটিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্ব ভারতে ৩০-৫০ শতাংশের বেশি ঘটে নাই। শহরের ঘরগুলিতে ৮০ শতাংশ বাড়িতে শৌচাগার থাকিলেও, গ্রামে আজও ৭০ শতাংশ গৃহে নাই। ইহাও সুস্বাস্থ্য এবং মানব-মর্যাদার পরিপন্থী। অপুষ্টি এবং পেটের অসুখ, দুইটিই যথাযথ শৌচ ও নিকাশি ব্যবস্থার সহিত জড়িত। অপুষ্টি এবং অসুস্থতা মেধা ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করে, ফলে দরিদ্র থাকিবার সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে শহর এবং গ্রামে পার্থক্য খুব সামান্যই কমিয়াছে। অর্থাৎ গ্রামের দ্রুত উন্নতি হইতেছে, এমন নহে।
নারীদের জীবনযাত্রার কাঠিন্যের দিকটিও প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। রান্না করিবার দায় যে নারীর, কেবল তাহাই নহে, ইন্ধনের ব্যবস্থার দায়িত্বও তাহার। শহরে রান্নার গ্যাস ব্যবহারের হার দ্রুত বাড়িতেছে, কিন্তু গ্রামে তাহার প্রচলন অতি সামান্য ৮০ শতাংশ গৃহস্থালি কাঠ, পাটকাঠি প্রভৃতি ফসলের অবশিষ্ট অংশ, ঘুঁটে, কয়লা প্রভৃতির উপর নির্ভরশীল। গ্রামে মাত্র এক শতাংশ গৃহস্থালি কেরোসিন-নির্ভর। মহিলাদের বহু সময় অপব্যয় হইতেছে ইন্ধন জোগাড় করিতে। দূষণকারী এবং অস্বাস্থ্যকর জ্বালানির প্রভাবে তাঁহারা নানা রোগে আক্রান্ত। গৃহজীবনের এই মৌলিক দিকটির প্রতি সরকারের সম্পূর্ণ অবহেলার কারণ ইহাই যে, এটি প্রধানত মহিলাদের কাজের ক্ষেত্র। তাহাদের শ্রমের দাম নাই, স্বাস্থ্যেরও মূল্য নাই, সুতরাং কাঠ কুড়াইতে এবং ঘুঁটে প্রস্তুত করিতে তাঁহাদের জীবনের একটি বড় সময় অতিবাহিত হইলে রাষ্ট্র তাহাতে বিচলিত হয় না। পানীয় জলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র কয়েক কোটি মহিলা আজও জল আনিতে প্রতি দিন মোট কয়েক লক্ষ কিলোমিটার হাঁটিয়া থাকেন। মানব সম্পদের এত অপব্যয় হইলে উন্নয়ন হইবে কী উপায়ে? |