নতুন ট্রেন বা রেললাইনের আশ্বাস তেমন মেলেনি। পূরণ হয়নি বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি। কিন্তু রেল বাজেট পেশ হওয়া ইস্তক বুধবার দিনভর যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রে রইল ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক। এবং যাত্রীদের একটা বড় অংশই জানালেন, এই ভাড়া বাড়ানোর ‘যুক্তি’ রয়েছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
এ বার বাজেটে জেলার প্রাপ্তি বলতে সাপ্তাহিক আসানসোল-চেন্নাই এক্সপ্রেস, আসানসোল-আদ্রা মেমু এবং কাটোয়া-আজিমগঞ্জ (ডেমু) ট্রেন। কলকাতা-চিত্তরঞ্জন ফাস্ট প্যাসেঞ্জারের যাত্রাপথ দেওঘর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। হাওড়া থেকে আসানসোল হয়ে রক্সৌল যাওয়ার একটি দ্বিসাপ্তাহিক ট্রেনও দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বরাদ্দ হয়েছে জামুড়িয়া-ইকড়া হয়ে অন্ডাল থেকে সীতারামপুর পর্যন্ত লাইনের বিদ্যুদয়নের পরিকল্পনা। অম্বিকা কালনা থেকে ধাত্রীগ্রাম এবং দাঁইহাট থেকে পাটুলি পর্যন্ত ডবল লাইন পাতার কাজ আগামী অর্থবর্ষেই শেষ করার লক্ষ্যমাত্রাও নেওয়া হয়েছে।
গত বছর, বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কল্পতরু’ বাজেটের তুলনায় এ বার দীনেশ ত্রিবেদীর বাজেট অনেকটাই ‘নিষ্প্রভ’, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রায় এক দশক পরে রেলের ভাড়া বাড়িয়ে নতুন রেলমন্ত্রী দিনভর তর্ক-বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়েছেন।
বর্ধমানে রাজ কলেজে পড়েন হুগলির হাজিগড়ের বাসিন্দা সাবির কয়াল। তাঁর মতে, “ভাড়া তো অল্পই বেড়েছে। এটুকু না বাড়লে যাত্রী স্বাচ্ছন্দের দিকে রেল নজর দেবে কী করে?” বর্ধমান শহরেরই ভাতছালায় বাড়ি দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী শুভময় ঘোষের। নিত্যযাত্রী শুভময়বাবুর মতে, “রেলের ভাড়া বাড়াই উচিত। এই সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য রেলমন্ত্রীকে যদি তাঁর দল শাস্তি দেয়, সেটা হবে তুঘলকী সিদ্ধান্ত।”
রানিগঞ্জের বাসিন্দা, প্রবীণ নিত্যযাত্রী কল্যানী বন্দোপাধ্যায়ের মতে, “যে হারে বেতন বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তাতে এই সামান্য ভাড়া বৃদ্ধি কারও গায়ে লাগার কথা নয়।” রেলকর্মীর স্ত্রী, চিত্তরঞ্জনের সুতপা পাইক বলেন, “আমি এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি। এর জন্য যদি রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়, সেটা আমাদের পক্ষে মানা কঠিন।”
বস্তুত, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলার বহু রেলকর্মীই একই মত পোষণ করেছেন। তবে এর উল্টো মতও আছে। বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা পাড়ার বাসিন্দা সংযুক্তা ভট্টাচার্য যেমন বলেন, “উচ্চ বা মধ্যবিত্ত মানুষের হয়তো অসুবিধা হবে না। কিন্তু রেল ভাড়া বাড়লে দিন আনা দিন খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের ভোগান্তি হবেই। সম্ভবত সে কথা মাথায় রেখেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাড়া বাড়ানোর বিরোধিতা করছেন।” বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এটা ঠিকই যে রেলের ভাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাড়েনি। ভাড়া না বাড়িয়ে সম্ভবত উপায় ছিল না। তবে এটা ঠিক সিদ্ধান্ত না ভুল, তা দলে আলোচনার আগে বলতে পারব না।”
ভাড়া বিতর্কের বাইরে, প্রাপ্তির দিক থেকে এ বার অবশ্যই জেলায় সবচেয়ে লাভবান আসানসোল। দুর্গাপুর থেকে হাওড়া ও শিয়ালদহগামী লোকাল ট্রেন এ বারও চালু হল না। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন লালুপ্রসাদ যাদব ওই আশ্বাস দিয়েছিলেন। রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া নির্দিষ্ট সময়সীমাও বেঁধে দেন। তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
তবে আসানসোল-চেন্নাই এক্সপ্রেস চালু হলে দুর্গাপুরের মানুষ পরোক্ষে লাভবান হবেন, সন্দেহ নেই। এত দিন দক্ষিণে যেতে হলে শিল্পাঞ্চলের মানুষকে হাওড়া হয়ে ঘুরে যেতে হত। গত রেল বাজেটের আগেই আসানসোলের ব্যবসায়ী মহল থেকে এ রকম একটি ট্রেন চালুর দাবি তোলা হয়েছিল। রক্সৌলের ট্রেন আসানসোল ছুঁয়ে যাওয়ায় শিল্পাঞ্চলের মানুষের পক্ষে নেপাল যাতায়াত সুবিধাজনক হল। তাতে পর্যটনপ্রেমী মানুষজন খুশি। আসানসোল চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি সুব্রত দত্ত জানান, মুম্বই যাওয়ার সরাসরি ট্রেনের দাবিও তোলা হয়েছিল। তবে তার জন্য হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।
২০১০ রেল বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছিল, ১৯৯৬-এ বন্ধ হয়ে যাওয়া অন্ডাল-বৈদ্যনাথধাম লোকাল ট্রেন ফের চালু করা হবে। তা হয়েছে। কিন্তু জামুড়িয়াকে ‘মডেল স্টেশন’ করার ঘোষণা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এই লাইনের অন্য স্টেশনগুলিও বেহাল। জামুড়িয়ার বণিক সংগঠনের সভাপতি অজয় খেতান, শিল্পপতি অশোক সান্থালিয়ারা অবশ্য আশাবাদী, অদূর ভবিষ্যতে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে। তবে রানিগঞ্জের বণিক সংগঠনের তরফে রাজু খেতানের আক্ষেপ, আসানসোল স্টেশনে ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম চালু করা এবং নয়াদিল্লি, রাজস্থান ও দিঘার ট্রেন চালানোর দাবি জানানো হলেও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি।
দিন কয়েক আগেই পূর্ব রেলের হাওড়া ডিভিশনের কাটোয়া-আজিমগঞ্জ শাখায় শিয়ালদহ-জঙ্গিপুর ট্রেন চালু হয়েছে। প্রথমে না দাঁড়ালেও, নিত্যযাত্রীদের আন্দোলনের পরে এখন ট্রেনটি সব স্টেশনে দাঁড় করানো হয়। এ বার ওই লাইনেই কাটোয়া-আজিমগঞ্জ ডেমু চালু হওয়ায় যাত্রীরা খুশি। নিত্যযাত্রী সংগঠনের নেতা চঞ্চল পান বলেন, “এই লাইনে যে ফের ট্রেন দেওয়া হবে, তা আমরা বুঝতে পারিনি। আমাদের সংগঠনের তরফে রেলমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এই ট্রেন চালু হলে নিত্য দিনের সমস্যা কিছুটা কমবে।” তবে পূর্ব রেলের বিবি লুপ লাইনের নিত্যযাত্রী সংগঠনের সভাপতি পুরবধি মুখোপাধ্যায়ের মতে, “ট্রেন দিয়ে আপাতত নিত্যযাত্রীদের আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করেছে রেল। কিন্তু ওই লাইনের বিদ্যুদয়ন বা ডবল লাইন করা নিয়ে কোনও প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ ওই লাইন মার খাচ্ছে।”
গত বার রেলবাজেটে কাটোয়া-পাটুলি ডবল লাইনের কাজ শুরুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আগামী আর্থিক বর্ষের মধ্যে দাঁইহাট থেকে পাটুলি পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। তবে নিত্যযাত্রীদের আশঙ্কা, জিরাট-কাটোয়া ডবল লাইনের কাজ এত ধীর গতিতে হচ্ছে যে কবে তা কবে শেষ হবে, আন্দাজ করা কঠিন। পাটুলির বাসিন্দা তথা কাটোয়া আদালতের আইনজীবী চন্দন সাহা বলেন, “পাটুলি স্টেশনেই দীর্ঘ দিন ধরে কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। রেলমন্ত্রীর কথায় আমরা আশ্বস্ত হই কী করে?”
আগামী অর্থবর্ষের মধ্যে অম্বিকা কালনা থেকে ধাত্রীগ্রাম পর্যন্ত ডবল লাইন তৈরির কাজ শেষ করার কথাও বলা হয়েছে বাজেটে। ব্যান্ডেল-কাটোয়া সাবার্বান প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক শিবু মুখোপাধ্যায় বলেন, “গত বারই অম্বিকা কালনা পর্যন্ত ডবল লাইনের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, এ বার অম্বিকা কালনা থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত ডবল লাইনের জন্য বরাদ্দ হবে। এটা হতাশাজনক।” ব্যান্ডেল-কাটোয়া লাইনে যাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায় কাটোয়া-শিয়ালদহ এবং হাওড়া-কাটোয়া লোকালের আবেদনও জানিয়েছিলেন তাঁরা। এই দাবি নিয়ে তাঁরা ফের আন্দোলনে নামবেন বলে শিবুবাবু হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
|