|
|
|
|
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় আতঙ্কিত ব্যাঙ্ক শিল্প, আখেরে ক্ষতি হবে চাষিদেরই |
ঋণ আদায়ে গিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন ব্যাঙ্ককর্মীরা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ঋণ শোধ না-করলেও চাষির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না, মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, মঙ্গলবার বকেয়া ঋণ আদায়ের জন্য এক মাছ ব্যবসায়ীর কাছে গিয়েছিলেন মালদহের সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মীরা। টাকা আদায় দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত পালিয়ে বাঁচতে হল তাঁদের!
কী হয়েছিল মালদহে?
ইংরেজবাজারের ওই ব্যবসায়ী মালদহ কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে ২০০৬ সালে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সুমন রায় বলেন, “আমাদের লোক এ দিন ঋণ শোধের তাগাদা দিতেই ওই ব্যবসায়ী চেঁচামেচি জুড়ে দেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমার জমি কেড়ে নিতে এসেছেন? পারলে জমি নিয়ে নিন। টাকা কোথা থেকে দেব!’ সুমনবাবু বলেন, “পরিস্থিতি এমন ঘোরালো হয়ে ওঠে যে বাধ্য হয়ে আমাদের চলে আসতে হয়।”
মুখ্যমন্ত্রীর কেন এমন ঘোষণা করলেন, তার নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে নানা মহল থেকে। ব্যাঙ্ক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ বলছেন, “পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখ চেয়ে কৃষক এবং গ্রামের অন্য পেশার মানুষদের পাশে পেতেই এমন সিদ্ধান্ত নিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে অন্যেরাও কৃষকদের বিরাগভাজন হতে চাইবেন না।” রাজনীতির কারবারিরাও অনেকেই এই সম্ভাবনার সঙ্গে একমত। তাঁদের কারও কারও বক্তব্য, ৯ মাস আগে বিধানসভা ভোটের সময় তৃণমূলের পক্ষে যে উন্মাদনা ছিল, তা খানিকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। সেটা আঁচ করে পঞ্চায়েত ভোটের জন্য এখন থেকেই ঘর গোছাচ্ছেন মমতা।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় রাজ্যের সমবায় ব্যাঙ্ক শিল্পে গেল গেল রব উঠেছে। সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে যারা ঋণ দেয়, সেই জাতীয় কৃষি ও গ্রামোন্নয়ন ব্যাঙ্কের (নাবার্ড) চিফ জেনারেল ম্যানেজার এস পদ্মনাভনের কথায়, “ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির হাত-পা বেঁধে দেওয়া হলে তার প্রভাব পড়বে গোটা ব্যাঙ্ক শিল্পের উপর।”
বক্তব্য পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে মঙ্গলবার চিঠিও দিয়েছেন রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। |
|
তমলুকের সেই সমবায় ব্যাঙ্ক। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস। |
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় ঋণ পরিশোধের বিষয়টি এ বার গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কায় ভুগছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিও। পশ্চিমবঙ্গে স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কারস কমিটির (এসএলবিসি) আহ্বায়ক এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সিএমডি ভাস্কর সেন বলেন, “ঋণ পরিশোধ করা না-হলে নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। এমন কোনও পদক্ষেপ করা ঠিক হবে না, যা ঋণ দেওয়া ও তা পরিশোধ করার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।”
ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা তমলুকের সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হবে বলে সোমবার জানিয়েছেন মমতা। এর পরে আর বকেয়া টাকা আদায়ের কথা ‘মুখ ফুটে’ বলার অবস্থাতেই নেই অন্য জেলার সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তারা। বর্ধমান কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান জহরলাল মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ২২২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ২০১ কোটি টাকা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় বিপাকে পড়েছি। চাষি যদি ঋণ শোধ না-করেন, তা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ভয় করবে। কারণ, সে ক্ষেত্রে আমাদের বিরুদ্ধেই এফআইআর হয়ে যেতে পারে।” সমবায় ব্যাঙ্কের এক কর্তার কথায়, “আমাদের কর্মীরা এখন রীতিমতো আতঙ্কে রয়েছেন।”
শুধু আতঙ্ক নয়, অস্তিত্বের সঙ্কটেও ভুগতে শুরু করেছেন বিভিন্ন সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তা ও কর্মীরা। চিন্তার কারণ, সমবায় ব্যাঙ্কগুলির পুঁজি সামান্য। তা থেকেই সাধারণ মানুষকে ঋণ দেওয়া হয়। গ্রামে মহাজনী কারবারের দুষ্টচক্রের ফাঁদ থেকে চাষিদের বাঁচাতে এই ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে ব্যাঙ্ক কর্তাদের দাবি। তাঁরা বলছেন, ঋণ পরিশোধ করতে না-হলে কিছু চাষি হয়তো সাময়িক ‘স্বস্তি’ পাবেন। কিন্তু বকেয়া আদায় না-হলে ব্যাঙ্ক নতুন করে ঋণ দিতে পারবে না।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি ম্যানেজার তীর্থঙ্কর নন্দী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে চাষিদের ঋণ শোধ করার প্রবণতাই আর থাকবে না। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে চলা মামলারও আর কোনও গুরুত্বই থাকল না। এতে ব্যাঙ্ক চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। অনেক ব্যাঙ্ক বন্ধও হয়ে যেতে পারে।” মুর্শিদাবাদ জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক লিমিটেডের এক কর্তা সমরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও বলেন, “এই দিনই চর রাজাপুর, সীতানগর ও মহারাজপুরের মতো কয়েকটি প্রাথমিক কৃষি ঋণ সমবায় সমিতির কর্তারা ব্যাঙ্কে এসে বলে গিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর তাঁদের পক্ষে আর ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব নয়।” ওই ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের
পরিমাণ ৭৪ কোটি টাকারও বেশি। কান্দির কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাঙ্কের মুখ্যনির্বাহী আধিকারিক সত্যনারায়ণ প্রামাণিকও বলেন, “বকেয়া টাকা আদায় করা না গেলে ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্বলবে।”
সমবায় ব্যাঙ্কগুলি বন্ধ হয়ে গেলে বা ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিলে আখেরে চাষিদেরই ক্ষতি হবে বলে ব্যাঙ্ক কর্তাদের অভিমত। কারণ চাষিদের তখন হাত পাততে হবে মহাজনের কাছে। এই পরিস্থিতির সব চেয়ে বড় উদাহরণ পুরুলিয়া কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। বর্তমানে ওই ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২ কোটি টাকার বেশি। ৪০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে শোধ করেননি বহু চাষি। ব্যাঙ্কের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সৌম্যনাথ মল্লিকের কথায়, “আইন প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে কিছু আদায় হয়তো করা যেত। কিন্তু নানা চাপে সে কাজও করা যায়নি। ফলে ওই সব এলাকায় ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হয়েছে। সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে মহাজন এবং স্বেচ্ছাসেবীদের মোড়কে বেসরকারি লগ্নি সংস্থা। এদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাষিরা ঋণের দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়ছেন।” তাঁর আশঙ্কা, “মুখ্যমন্ত্রী সমবায় আইন বদলে ফেললে ছোট-মাঝারি চাষিরা আগামী দিনে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বেন।” অন্য দিকে অশোকবাবুর অভিযোগ, “গ্রামের মহাজন আর মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাগুলিকে উৎসাহিত করতে সমবায় ব্যাঙ্ক তুলে দিতে চাইছে সরকার।” |
|
ঋণ পরিশোধ না-করলে কৃষকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সমবায় আইনটি বাম আমলে ২০০৬ সালে তৈরি হয়েছে বলে সোমবার মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বাস্তবে এই আইন তৈরি হয় ১৯০৪ সালে। স্বাধীনতার আগে ১৯১২ এবং ১৯৪০ সালে তা সংশোধিত হয়। স্বাধীন ভারতে ১৯৭৩ সালে কংগ্রেস আমলে ফের সংশোধন করা হয় আইনটি। তার ৪৮ক ধারায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয়। সেই আইন বাম আমলে ১৯৮৩ সালে সংশোধন হলেও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার থাকে ৫৩ নম্বর ধারায়। সর্বশেষ ২০০৬ সালে ফের ওই আইনের কিছু অংশ সংশোধন হলেও ১২২ ধারায় একই অধিকার স্বীকৃত রয়েছে। এ নিয়ে অশোকবাবুর তির্যক মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রীকে যাঁরা তথ্য জুগিয়েছেন, তাঁরা সবটা বলেছেন বলে মনে হয় না।”
পশ্চিমবঙ্গে চাষের কাজে ঋণ দেয় মূলত তিন ধরনের ব্যাঙ্ক। গত আর্থিক বছরে তারা মিলিত ভাবে মোট ঋণের ৭২% অর্থ ফেরত পেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় ঋণ পরিশোধ করার প্রবণতা আরও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। সমবায় থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তারা প্রত্যেকেই একমত, ব্যাঙ্কের হাতে সম্পত্তি বন্ধক নেওয়া অথবা ক্রোক করার অধিকার না-থাকলে ঋণের টাকা ফেরত পেতে অনেক বেশি সমস্যা হবে। এ প্রসঙ্গে অশোকবাবুর মন্তব্য, “গরুকে গাড়ির সঙ্গে জুড়ে দিলেই ছোটে না। এ জন্য হাতে ছড়ি থাকতে হয়।”
তবে ঋণ শোধের জন্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইন থাকলেও কার্যক্ষেত্রে সেই ‘চরম পথ’ যে খুব বেশি নিতে হয়েছে, এমন নয় বলে জানাচ্ছেন ব্যাঙ্ক কর্তারা। অর্থাৎ তমলুকের ওই ব্যাঙ্ক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নোটিস দিলেও সেটা খুব ‘নিয়মিত চিত্র’ নয়। সমবায় ব্যাঙ্কের এক কর্তা বলেন, “বকেয়া ঋণ আদায়ে নোটিস জারি হলেও বাস্তবে এ রাজ্যে গত সাড়ে তিন দশকে কার্যত কোনও চাষির জমি বা সম্পত্তি নিলাম হয়নি। এটা করা হয় স্রেফ ভয় দেখাতে। বালুরঘাট কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান বিমল সরকার বলেন, “গত বছরই আমরা ১৮ জন ঋণগ্রহীতার কাছে সম্পত্তি নিলামের নোটিস পাঠাই। এতে ভয় পেয়ে সকলেই ঋণ শোধ করে দেয়।”
ভাস্করবাবুও বলেন, “সাধারণত আমরা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে কোনও বন্ধক রাখি না। কেউ ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাঁকে আরও সময় দেওয়া হয়। প্রয়োজনে লোক আদালতের কাছে যাওয়া হয়। তাই বন্ধকী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রয়োজন বিশেষ হয় না।”
আর অশোকবাবুর বক্তব্য, ছোট চাষিদের ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে কোনও জামানত রাখা হয় না। এঁদের ক্ষেত্রে পরিশোধের হারও বেশি। কিন্তু দেখা গিয়েছে, যাঁরা এক লক্ষ টাকার বেশি ঋণ নেন, তাঁদের পরিশোধের হার খুব খারাপ। এঁরা সর্বাধিক পাঁচ বছর সময় পেয়েও ঋণ পরিশোধ করে না। তাঁর কথায়, “এই ঋণখেলাপি অংশটিকে বাধ্য করার জন্য আইন সংশোধন করে আরও শক্তিশালী জরিমানার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর কথায় গরিব ও প্রান্তিক নন, বরং সম্পন্ন চাষিরাই লাভবান হবেন।” |
|
|
|
|
|