|
|
|
|
দোতলা বাড়ি, পাওয়ার টিলার, তবু ঋণ বাকি |
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
নোটিস পাওয়ার পরে সাত জন ঋণগ্রহীতা টাকা শোধ করে দিয়েছিলেন। দু’জন দেননি। সেই দু’জনের জন্য ছাপানো পোস্টার মেরেই এখন গভীর সঙ্কটে তমলুকের সমবায় ব্যাঙ্ক।
ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁরা নিয়ম মেনেই দুই ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওই দু’জন টাকা মেটাবেন না বলে গোঁ ধরে থাকেন। তাই তাঁদের সম্পত্তি নিলামের জন্য ১৬ এবং ১৯ মার্চ দু’টি দিন ঠিক করা হয়েছিল। এই ভয় না দেখালে কখনওই টাকা পাওয়া যেত না বলে দাবি ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষের। এ ভাবে তাঁরা ভাল ফল পাচ্ছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার ব্যাঙ্কের সর্বোচ্চ-কর্তাকে মহাকরণে ডেকে পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। যার নিট ফল, ওই নিলাম স্থগিত হয়ে গিয়েছে।
ব্যাঙ্কের কর্তারা বলছেন, প্রক্রিয়াটি থমকে গেলে বিপদে পড়বে সমবায় ব্যাঙ্ক। তার চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ক্ষুদ্র চাষিরাই। সমবায়ের সামর্থ্য হবে না আর ঋণ দেওয়ার। তখন মহাজনি ঋণের জাঁতাকলে আরও জর্জরিত হবেন কৃষিজীবীরা। |
|
কুরপাই গ্রামে পঞ্চানন চৌধুরীর বাড়ি। |
কিন্তু ব্যাঙ্কের নোটিস পেয়েও কেন ঋণ শোধে উদ্যোগী হলেন না কুরপাই গ্রামের পঞ্চানন চৌধুরী (তাঁর নামে জারি হওয়া নিলাম-পোস্টারই মহাকরণে দেখিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী) কিংবা চাঁতরাদাঁড়ি গ্রামের নিতাই মাইতি? তাঁদের পারিবারিক অবস্থা কি সত্যিই খুব খারাপ?
পঞ্চাননবাবুর বয়স ৭৬। পাঁচ ছেলে। কেউই বেকার নন। দুই ছেলের তাঁত রয়েছে। দুই ছেলে চাষাবাদ করেন। অন্য জন প্রতিমা-শিল্পী। ২০০৫-এর অক্টোবরে মূলত পান-বরোজের জন্য আড়াই বিঘা জমি বন্ধক রেখে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন পঞ্চাননবাবু। ২০০৭-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৪৬৯০ টাকা শোধ করেছেন। ২০০৮, ’০৯, ‘১০ এবং ২০১১-য় পরপর নোটিস দিয়ে ঋণ শোধের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল ব্যাঙ্কের তরফে। কিন্তু চৌধুরী পরিবার গুরুত্ব দেননি বলেই অভিযোগ। এমনকী ৩ মাস, এক মাসের চরমপত্র দেওয়ার পরেও ঋণ অনাদায়ী থাকায় বাধ্য হয়েই নিলামের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে ব্যাঙ্ক কতৃর্পক্ষ জানান।
দোতলা বাড়ি, নিজস্ব পাওয়ার-টিলার থাকা চৌধুরী পরিবারের পক্ষে কি সত্যিই অসম্ভব ছিল ঋণ পরিশোধ করা? পঞ্চাননবাবুর মেজোছেলে মধুসূদন প্রথমে বলেন, “পরপর তিন বছর পান চাষে ক্ষতির জন্যই ঋণ মেটানো যায়নি।” পরে আবার বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিঋণ মকুবের ঘোষণা করায় ২০০৭-এর মার্চের পর আর ঋণ মেটাইনি।” কিন্তু সব রকম কৃষিঋণই তো আর মকুব হয়নি? তখন মধুসূদন বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ব্যাঙ্ক আমাদের ছাড় না দেওয়াতেই টাকা মেটানো হয়নি।” গত ২৩ ফেব্রুয়ারি চৌধুরীবাড়িতে নোটিস দিতে এসে ব্যাঙ্ক আধিকারিক অশোক মণ্ডল রীতিমতো ঘেরাও হয়ে গিয়েছিলেন। শেষে পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করেছিল।
বছর চল্লিশের নিতাই মাইতি চাষাবাদ করেন, সঙ্গে দোকানও আছে। দোতলা পাকা বাড়ি। এক ছেলে, এক মেয়ে। ধান চাষের জন্য ২০০৬-এর জুলাই মাসে ৫২ ডেসিমেল জমি বন্ধক রেখে ৩৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখন সুদেমূলে সেটা দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৭৭ টাকা। তিনিও সেই ২০০৭-এর মার্চে শেষ বার ২৩৮৯ টাকা জমা দিয়েছিলেন ব্যাঙ্কে। বাকি ঋণ শোধ করেননি কেন? নিতাইবাবুও সেই কেন্দ্রীয় ঘোষণায় ঋণ মকুবের কথাই পাড়লেন।
পঞ্চাননবাবু, নিতাইবাবুর মতো পূর্বনখা গ্রামের নারায়ণ মাইতি কিন্তু কোনও ওজর-আপত্তি তোলেননি। ব্যাঙ্কের নোটিস পেয়ে ঋণ শোধের জন্য যোগাযোগ করেছেন।
তমলুক কো-অপারেটিভ এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক লিমিটেডের চেয়ারম্যান তথা তৃণমূলের শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লক সভাপতি এবং কাঁখরদা পঞ্চায়েতের প্রধান নিকুঞ্জ মান্নার আক্ষেপ, দলনেত্রীকে কেউ ‘ভুল বুঝিয়েছে’। তাঁর বক্তব্য, “আমরা সব নিয়ম মেনেই কাজ করেছি। নিয়মানুযায়ী সরকারি আধিকারিক অর্থাৎ অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার অফ কো-অপারেটিভ সোসাইটিজ-এর (এআরসিএস) অনুমোদন সাপেক্ষেই নিলাম-নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তার পরেও যে কেন ভুল বোঝাবুঝি হল বুঝতে পারছি না।” |
|
চাতরাদাঁড়ি গ্রামে নিতাই মাইতির বাড়ি। |
এমন নিলামে অনিয়ম দেখছেন না কাঁথি কো-অপারেটিভ এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান তথা তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও। তাঁর মন্তব্য, “বিষয়টি সমবায় আইনেই আছে।”
তমলুকের সমবায় ব্যাঙ্কটির ম্যানেজার প্রণবকুমার ভুঁইয়া জানিয়েছেন, তাঁদের শাখায় ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ৬৩৫৪ জন। চলতি আর্থিক বছরের শেষে ১৮ কোটি ৯২ লক্ষ ২১ হাজার ৬৯৯ টাকা মেটাতে হবে সেন্ট্রাল ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিএলডি) ব্যাঙ্কে। সেখান থেকে ঋণ নিয়েই কৃষকদের দেওয়া হয়। সিএলডি আবার ঋণ পায় নাবার্ড থেকে। এখন তমলুকের সমবায় ব্যাঙ্কটি সিএলডিকে টাকা মেটাতে না পারলে তারা সমস্যায় পড়বে। নাবার্ডে ঋণখেলাপি হবে সিএলডি। সেখান থেকে টাকা বন্ধ হলে সিএলডি-ও সমবায়কে ঋণ দিতে পারবে না। তখন কৃষকরা প্রয়োজনের সময়ে ঋণ নিতে এলে সমবায়ের পক্ষেও তাদের সাহায্য করা সম্ভব হবে না।
তমলুকের সমবায় ব্যাঙ্কটির একাধিক আধিকারিকের বক্তব্য, অনাদায়ী ঋণ আদায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিও একই ভাবে সম্পত্তি নিলাম করে। ছবি-সহ নোটিসও দেয় খবরের কাগজে। কিন্তু সমবায় ব্যাঙ্ক কখনওই চায় না, কৃষক জমি-জায়গা হারান। বহু বার তাগাদার পরে উপায়ান্তর না থাকলে তবেই নিলামের নোটিস দিতে হয়। এই নোটিসও আবার অনেকটাই ‘চাপ’ তৈরির জন্য। নোটিস জারি হলে অনেকেই ঋণ মিটিয়ে দেন। নিয়ম মেনে সে ক্ষেত্রে সুদের হিসাবে যথাসম্ভব ছাড়ের ব্যবস্থাও করা হয়। এ বারও যেমন ৯ জনের জমির নিলাম-নোটিসের পর ৭ জনই ঋণ শোধ করেছেন।
এখনই তমলুকের সমবায় ব্যাঙ্ক-শাখায় ঋণ পরিশোধের হার মাত্র ১২.৯ শতাংশ। এই হার অবিলম্বে না বাড়াতে পারলে ব্যাঙ্ক এমনিতেও গভীর সঙ্কটে পড়বে। সে কারণেই অনাদায়ী ঋণ-আদায়ে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে কয়েক জনের জমি নিলামের নোটিস দেওয়া হয়েছিল বলে ব্যাঙ্কের পরিচালন কর্তৃপক্ষের দাবি। আর যে দু’জনের জমির নিলাম স্থগিত করতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ‘নিষেধাজ্ঞা’র পর তাঁরা কেউই ঋণ পরিশোধে অপারগ নন বলেও দাবি সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের।
ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, নোটিসের চাপ তৈরি করে একটু শ্বাস নেওয়ার অবস্থা তৈরি করা হচ্ছিল। এখন ফের শ্বাসরুদ্ধ অবস্থাই ফিরতে চলছে। তা হলে কি সমবায়ে লালবাতিই ভবিতব্য? আশঙ্কায় সমবায় কর্তারা। তাঁরা আরও বেশি শঙ্কিত, কৃষিজীবীদের মহাজনি খপ্পরে পড়ার কথা ভেবে।
|
মঙ্গলবার পার্থপ্রতিম দাসের তোলা ছবি। |
|
|
|
|
|