ধান লাগানোর মরসুম শেষ হয়ে গেলেও, জমিতে জলের দেখা নেই। জল পড়ে রয়েছে ক্যানালের তলানিতে। বিঘার পর বিঘা জমিতে শুকিয়ে হলুদ হয়ে গিয়েছে বোরো ধানের বীজতলা। ক্ষতির মুখে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তত ৩৬ হাজার ছোট বড় কৃষক। তিস্তা ক্যানালে বা হাতি এবং ডানখাতি খালের নতুন এলাকায় গত জানুয়ারি মাসে জল ছাড়া হয়। ঘটা করে সরকারি অনুষ্ঠান করে জানানো হয়, ২২ বছর পর তিস্তা ক্যানালের বাঁ এবং ডান হাতি খাল মিলিয়ে নতুন ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে জল পৌঁছে যাবে। সেই জলে কৃষকরা বোরো চাষ করে লাভের মুখ দেখবেন। অথচ জল ছাড়ার তিন মাসের মাথায় খোদ সরকারি রিপোর্টই বলছে, জল না মেলায় জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বোরো চাষের ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। মরসুম চলে যাওয়ায় এই ক্ষতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে বেশি করে জল দিলেও বোরোর ফলন হবে না বলেই কৃষি দফতর জানিয়ে দিয়েছে। জেলার মালবাজার, ক্রান্তি থেকে শুরু করে সদর ব্লকের মন্ডলঘাট, বোয়ালমারি সর্বত্রই কৃষকদের একটাই অভিযোগ, ক্যানালের তলানিতে পড়ে থাকা জল কোনও ভাবেই জমিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। |
সোমবার জেলার খড়িয়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, মূল ক্যানাল থেকে যে ফিল্ড চ্যানেলের মাধ্যমে চাষের জমিতে জল নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফিল্ড চ্যানেলের মুখ থেকে এক-দেড় ফুট নিচ দিয়ে জল বইছে। তার ফলে ক্যানেলে জল থাকলেও পাশের বিস্তীর্ণ জমি শুকিয়ে খটখটে হয়ে রয়েছে। জলপাইগুড়ি জেলার কৃষি দফতরের শস্য রক্ষা আধিকারিক তপন সরকার বলেন, “জলের অভাবে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর পরিমাণ জমিতে বোরো চাষ মার খেয়েছে। এখন জল দিয়েও আর চাষ হবে না। কোটি টাকারও বেশি ধান বাজারে আসতে পারল না। বার বার তিস্তা সেচ কর্তৃপক্ষকে বেশি পরিমাণ জল ছাড়ার কথা বলা হয়েছিল।” ক্যানালের জল নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে কৃষি দফতর ও সেচ দফতরের মধ্যে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষি দফতর থেকে চিঠি পাঠিয়ে ক্যানালে জল পাওয়া যাচ্ছে না বলে সেচ দফতরকে জানানো হয়। তার উত্তরে সেচ দফতর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় ক্যানালে প্রয়োজন মতো জল রয়েছে। সেচ দফতরের ওই চিঠি পেয়ে কৃষি দফতর থেকে রাজ্যকে গোটা পরিস্থিতির কথা জানানো হয়। সেচ দফতরে পাল্টা চিঠি পাঠিয়ে দুই দফতরের যৌথ পরিদর্শনের প্রস্তাব পাঠায় কৃষি দফতরে। যদিও সেই প্রস্তাবের কোনও উত্তর আসেনি বলে কৃষি দফতরের অভিযোগ। এ দিন অবশ্য তিস্তা সেচ দফতরের ব্যারাজ ডিভিশনের অধীক্ষক বাস্তুকার গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চলতি সপ্তাহের শেষে কৃষি দফতরের সঙ্গে বৈঠক করব। প্রয়োজনে যৌথ পরিদর্শনও হবে।” তিনি দাবি করেন, ক্যানালে জল নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। তবে এ বছর বেশির ভাগ এলাকাতেই প্রথমবার জল দেওয়া হয়েছে। সে কারণে প্রথমবার জল দিলে যেমন কিছু পদ্ধতিগত সমস্যা আসে, তেমনিই হয়েছে। তা ছাড়া দীর্ঘদিন পড়ে জল ছাড়া হয়েছে, ক্যানেলেরও একটি বহনক্ষমতা রয়েছে। তবে খুব একটা সমস্যা নেই। |
সদর ব্লকের খড়িয়া এলাকার কৃষক রবি রায় বলেন, “এ বছর ক্যানালে জল দেবে বলে জানিয়ে কৃষি দফতরের কর্তারা বোরো ধান চাষ করার পরামর্শ দিলেন। তাই আলু চাষ না করে বোরো করলাম। জলের জন্য তিন মাস ধরে অপেক্ষা করে রয়েছি। ক্যানালের নিচে সরু সুতোর মতো জল বইছে। সেই জল জমিতে আসে না। সমস্ত চারা বরবাদ হয়ে গেল।” গত বছরের নভেম্বর মাসে তিস্তা সেচ দফতর জানায়, বাঁ হাতি খালের প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে চলতি মরসুমে প্রথমবার জল ছাড়া হবে এবং ডান হাতি খালের নতুন সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতেও এবারে জল পাওয়া যাবে। সেই মতো কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে এই এলাকার কৃষকদের অন্য কোনও শস্য চাষ না করে বোরো ধান চাষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ, ক্যানেলে জল এলেও তার পরিমাণ এতই সামান্য যে সেই জল জমিতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক আধিকারিকের কথায়, “আর বৈঠক করে লাভ হবে না। এখন জল দিলেও বোরো চাষ হবে না, উল্টে পাট চাষিরা মারা পড়বেন।”
|