পুনর্বাসন এবং প্রতিরোধ।
সকলেই এক বাক্যে বলছেন, শিশুশ্রম রুখতে হলে এই দু’টো কাজই করতে হবে। অর্থাৎ শিশুশ্রমিকদের উদ্ধার করে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা এবং শিশুশ্রমের বাড়বাড়ন্ত হওয়ার রাস্তাটা রুখে দেওয়া। তার জন্য শুধু আগ্রহ থাকলেই হবে না, উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবের কথা উঠে এসেছে বারবারই।
কোনও শিশুশ্রমিককে যদি উদ্ধারও করা হয়, তার জায়গায় নিযুক্ত হয় অন্য কোনও শিশু। ফলে শিশুশ্রমের সার্বিক চিত্রে বদল হয় না। আবার, উদ্ধার হওয়া শিশুকেও কি সব সময় দেওয়া যায় পুনর্বাসন?
বছর দশের বাবলু কাজ করত এক সেনা অফিসারের বাড়িতে। অত্যাচারের জেরে কয়েক মাস আগে সে পালিয়ে আশ্রয় নেয় শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। জিআরপি-র হাত ঘুরে ছেলেটির ঠাঁই হয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোমে। ওই সংস্থারই উদ্যোগে অভিযুক্ত সেনা-অফিসারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু বাবলু? তাকে ফিরে যেতে হয়েছে শিশুশ্রমিকের কাজেই। কেবল বদলে গিয়েছে ওর কর্মক্ষেত্র।
উদ্ধারকারী সংস্থার সূত্রে খবর, অভিযুক্ত সেনা-অফিসারের গ্রামের বাড়িতে কাজ করেন বাবলুর বাবা। ফলে পরিবারের তরফে অভিযুক্তকে সাজা দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি নেই। সরকারের তরফেও অভিযুক্তদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে হেলদোল নেই বলে অভিযোগ। শ্রম দফতরের ব্যাখ্যা, “বাচ্চাটিকে যে শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা প্রমাণ করা খুব শক্ত। কারণ সেক্ষেত্রে গৃহস্থরা তাকে পালিত পুত্র বা কন্যা বলে দাবি করেন। এ ব্যাপারে অভাবী বাবা-মায়ের সহযোগিতাও মেলে না।”
নিয়মিত নজরদারির অভাবে শিশুশ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হলেও ব্যবস্থা নিতে পারে না শ্রম দফতর। শিশুশ্রম আইনের উপর নজর রাখার জন্য আলাদা কোনও অফিসারই নেই। অথচ শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধকরণ আইন অনুযায়ী অপরাধীদের ২০ হাজার টাকা জরিমানা করার কথা। শ্রমসচিব ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত বলেন, “সম্প্রতি এ দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। মহেশতলায় তিনটি এবং ব্যারাকপুরে পাঁচটি মামলা হয়েছে।” একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কো-অর্ডিনেটর দিলীপ বসু বলেন, “আমাদের মতো বিভিন্ন সংস্থা প্রায়শই মামলা করে। গত নয় মাসে কেবল আমাদের সংস্থাই কলকাতায় ১৬টা এফআইআর করেছে।”
কিন্তু উদ্ধার হওয়া শিশুশ্রমিকরা যাবে কোথায়? স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর কথায়, “আমরা বড়জোর শিশুটিকে উদ্ধার করে থানায় ডায়েরি করতে পারি। কিন্তু বাচ্চাগুলোকে কোথায় রাখা হবে? নিজেদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিলে ফের আয়ের খোঁজে ওরা শ্রমিক হয়ে যায়।” |
রাজ্যের সমাজকল্যাণমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রও হোমের অভাবের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর হিসাবে, রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি হোমের সংখ্যা যথাক্রমে ২৮ ও ২৯। তাঁর মতে, “বোলপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহের মতো নানা জায়গায় হোম নেই। কলকাতাতেও সরকারি হোম নেই। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছি জমি বরাদ্দ করতে।”
সার্বিক ভাবে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শ্রম দফতরের পরিকাঠামোর অভাব প্রকট। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার যুগ্মপ্রধান রাজীব হালদার বললেন, গোড়াতেই গলদ। শিশুশ্রমিকদের পুনর্বাসনের বিষয়টি শ্রম দফতরের পরিবর্তে শিশুকল্যাণ দফতরের আওতায় থাকলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির সুবিধা পাওয়া যেত অনেক বেশি। শিশুদের জন্য যে আইসিপিএস (ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড প্রোটেকশন স্কিম) প্রকল্প রয়েছে, তার সুফল পেতে পারত শিশুশ্রমিকরা। যেমন, জেলায় জেলায় শিক্ষার অধিকার আইন যদি সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা হয়, তা হলে এমনিতেই সব শিশু নিখরচায় বুনিয়াদি শিক্ষার আওতায় এসে পড়ত। শিশুশ্রমিকদের জন্য আলাদা স্কুল রাখার প্রয়োজনই থাকত না!
তবে কেন্দ্রীয় সরকারের শিশুশ্রম সংক্রান্ত আইনও বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। ওই আইনে শিশুশ্রম বিলোপ করার বদলে ৫৫টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কাজের তালিকা দিয়ে শিশুদের তা থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে। ওই তালিকায় কৃষি নেই। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী অভীক ভট্টাচার্য প্রশ্ন তুললেন, ১২ বছরের শিশুকে দিয়ে কীটনাশক ছড়ানো হলে তা কি ঝুঁকিপূর্ণ হবে না? তা ছাড়া রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশুর অধিকার সংক্রান্ত প্রস্তাবে (ইউএনসিআরপি, ১৯৯২) সই করেছিল ভারত। সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, ১৮ বছরের কমবয়সীদের শিশু বলে গণ্য করতে হবে। অথচ কেন্দ্রের যে শিশুশ্রম আইন, সেখানে বয়সের উর্ধ্বসীমা রাখা হয়েছে ১৪। শিক্ষার অধিকার আইনেও ১৪ বছর পর্যন্ত নিখরচায় শিক্ষার কথাই বলা আছে। ১৪-১৮ বছর বয়স্কদের কেন শিশুর অধিকার দেওয়া হবে না, স্বভাবতই তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আশার কথা, আইনে সংশোধনী আনার কথা ভাবছে কেন্দ্র।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো একটা ব্যাপারে একমত। শিশুশ্রমের প্রতিকার তখনই সম্ভব, যখন সরকারি তরফে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকবে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সহায়ক এবং পরিপূরক ভূমিকা নিতে পারে, কিন্তু মূল কাজটা করতে হবে সরকারকেই। কী রকম? ওঁরা বলছেন ব্লক স্তর থেকে দরিদ্র পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করার কাজে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো তখনই কার্যকর হয়ে উঠতে পারে, যখন তারা পঞ্চায়েত এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করবে। সেই পরিবারগুলির গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের ১০০ দিনের কাজে নিতে হবে। অর্থাৎ সরকারি প্রকল্প এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নজরদারি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচির মধ্যে প্রকৃত সমন্বয় প্রয়োজন। এবং রাজীবের মতে এই সমন্বয়ের কাজটা প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে অপেক্ষাকৃত ভাল হচ্ছে বলেই তারা শিশুশ্রমিকের সংখ্যা অনেকটা কমাতে পেরেছে। অন্য একটি সংগঠনের প্রধান মানবেন্দ্রনাথ রায় এ-ও মনে রাখতে বলছেন, পাশের রাজ্যগুলো থেকে এখানে কাজ খুঁজতে আসার প্রবণতা বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমন কিন্তু নয়। শুধু সেই পরিসংখ্যানটা আলাদা করে সরকারি রিপোর্টে উঠে আসছে না।
|
সহ প্রতিবেদন: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়। |