আগামী বছর পঞ্চায়েত ভোটে হাওড়া জেলায় প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ‘কঠোর’ হচ্ছে তৃণমূল।
দলের তরফ থেকে ইতিমধ্যেই কারা প্রার্থী হতে পারবেন সে বিষয়ে একটি নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশিকা মোতাবেক, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এমন কাউকে প্রার্থী করা যাবে না। তা ছাড়া, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বা মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন, এমন কেউও প্রার্থী হতে পারবেন না।
ঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হলে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে দেরি আছে অন্তত এক বছর। কিন্তু এখন থেকেই হাওড়া জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিল তৃণমূল। তারই প্রস্তুতি হিসাবে জেলার ১৫৭টি পঞ্চায়েতের প্রতিটি সংসদে প্রার্থী নির্বাচনের কাজ সেরে ফেলার জন্য দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজ্য চালালেও প্রতিটি সংসদে প্রার্থী বাছাই করার কথা ভাবছে কেন তৃণমূল? তবে কি পঞ্চায়েত ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হবে না ধরে নিয়েই এগোচ্ছে তৃণমূল শিবির?
হাওড়া জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের কৃষি বিপণনমন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “কংগ্রেসের সঙ্গে যদি জোট অটুট থাকে, তা হলে দলীয় নির্দেশ মেনে প্রার্থী তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু জোট না-হলেও যাতে প্রার্থী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমস্যা না-হয় সেই জন্যই আমরা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।” মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জেলায় শুরু হয়েছে পঞ্চায়েতিরাজ সম্মেলন। প্রতিটি বিধানসভা ধরে ধরে সম্মেলন হচ্ছে। সম্মেলন থেকেই দলীয় কর্মীদের প্রার্থী নির্বাচনের কাজ সেরে ফেলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
জেলায় বামফ্রন্টের ‘পিছু হঠা’র শুরু ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে। সে বার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে জেলার তিন চতুর্থাংশ আসন বামেদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। জেলা পরিষদে অবশ্য জোট না-হওয়ায় কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে ভোট ভাগাভাগির সুযোগ নিয়ে বামেরাই ক্ষমতায় থেকে যায়। তার পর লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা পিছু হটে। বিধানসভা নির্বাচনে জেলার ১৬টি আসনই পায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোট।
এত ‘শক্ত ভিত’-এর উপরে দাঁড়িয়েও তৃণমূল এত আগে থেকে কেন পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিল?
জেলা তৃণমূল সভাপতির কথায়, “নির্ধারিত সময়ে হলে আগামী বছরের মে মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচন তার আগেও হয়ে যেতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে যাতে বিপাকে পড়তে না-হয় তার জন্যই আমরা দলের তরফে প্রস্তুতি সেরে রাখছি।”
অন্য মতামতও অবশ্য উঠে এসেছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের কথায়। তাঁদের মতে, বিভিন্ন নির্বাচনে জেলায় তৃণমূল ‘সাফল্যের স্বাদ’ যেমন পেয়েছে, অন্য দিকে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। অনেক পঞ্চায়েত এমনকী পঞ্চায়েত সমিতিতেও দলীয় প্রধান এবং সভাপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে শুধু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে।
আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনেও প্রতিটি গোষ্ঠী এবং উপ-গোষ্ঠীর নেতারা চাইবেন তাঁদের অনুগামীদেরই প্রার্থী করতে। শুধু তাই নয়, বিধানসভা নির্বাচনের পরে কংগ্রেস ছেড়ে অনেক পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সমিতির সদস্য এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। প্রার্থী হওয়ার জন্যই তাঁরা দল বদল করেছেন বলে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ধারণা। এই অবস্থায় প্রার্থী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জটিলতা দেখা দেওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। এই জটিলতা যাতে আগেভাগে সামাল দেওয়া যায় সেই কারণে প্রার্থী নির্বাচনের কাজটি সেরে ফেলা হচ্ছে।
জেলা তৃণমূলের এক প্রভাবশালী সদস্য বলেন, “যে সব গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতিতে আমরা ক্ষমতায় রয়েছি তার অনেকগুলিতেই গোষ্ঠী কোন্দল সামাল দিতে আমরা জেরবার। এখন জেলায় যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে প্রত্যেকে ভাবছেন আমাদের দলের টিকিটে দাঁড়ালে জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী। ফলে প্রার্থী হওয়ার জন্য চাপও অনেকটাই বাড়বে। প্রার্থী নির্বাচনের কাজটি সেরে রাখলে শেষ মুহূর্তের গোলমাল অনেকটা এড়ানো যায়।” এক সময়ে এর ঠিক উল্টোটাই ঘটত। বামফ্রন্ট ‘নীরবে’ প্রার্থী নির্বাচনের কাজ সেরে ফেলত। বামফ্রন্ট বিরোধীরা আসরে নামত একেবারে শেষ পর্যায়ে। এ বারে জেলায় রাজনৈতিক ভাবে জমি হারিয়ে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট কার্যত দিশাহারা। নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যস্ত কংগ্রেসও। এই অবস্থায় আগে থেকে প্রার্থী বাছাই-সহ নির্বাচনের কাজে নেমে পড়তে পারলে নির্বাচনী লড়াইয়ে তৃণমূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকবে বলে জেলার রাজনৈতিক মহল মনে করছে।
জেলা তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “রাজ্যে পুরোদস্তুর ক্ষমতায় থেকে এই প্রথম একটি নির্বাচনে যাচ্ছি আমরা। এক দিকে গোষ্ঠী কোন্দল, অন্য দিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে অনেক বিরুদ্ধ সমালোচনাকেও। এই অবস্থায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চাই না।” |