|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
কলেজ-ভোটেও নির্বাচন কমিশন
রাজনীতিমুক্ত শিক্ষার স্বপ্ন অলীক? |
শিক্ষায় রাজনীতির অনুপ্রবেশই সংকটের মূল। এই রাজ্যে সেই ছবি আরও ভয়াবহ। কলেজ ভোট প্রসঙ্গে
আদালতের সাম্প্রতিক নির্দেশ সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দেবে না তো? প্রশ্ন তুলেছেন
কৃষ্ণা বসু |
বিচারব্যবস্থা যখন কোনও নির্দেশ জারি করেন, তা শিরোধার্য করাই রীতি। তার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাও হয়তো অনুচিত। সম্প্রতি খবরকাগজ খুলে চোখে পড়ল, কলেজে ভোটের দায়িত্ব নেবেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার, এমনই নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। সঙ্গে সঙ্গে ভোটের সঙ্গে পুলিশি ব্যবস্থা করতেও নির্দেশ গিয়েছে পুলিশের অধিকর্তার কাছে। মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা ধাক্কা লাগল।
মন্দিরে প্রদত্ত জীবের বলিদান দেখে রবীন্দ্রনাথের বালক জিজ্ঞাসা করেছিল এত রক্ত কেন? বেশ কিছু কাল ধরে রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ প্রশ্ন তুলেছিলেন, শিক্ষাজগতে এত হিংসা কেন? এর জবাবে সকল পক্ষই যেন স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কারণ একটাই রাজনীতির অনুপ্রবেশ।
|
যুদ্ধং দেহি |
কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন যখন হয়, তখন ছাত্রদের ভাল-মন্দের নিরিখে নিজেদের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন জাতীয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতিক দলগুলি পরস্পরের সঙ্গে ‘যুদ্ধং দেহি’ বলে নেমে পড়েছে। ছাত্ররা আর তখন ঠিক ছাত্র নন, তারা হয় কংগ্রেস, নয় সি পি এম, নয়তো তৃণমূল বা আর কিছু।
সে দিক থেকে বিবেচনা করলে আদালত তো ঠিক কথাই বলেছেন। যেমন করে ইদানীং কালে সাধারণ নির্বাচন হয়, তেমন ভাবেই কলেজের নির্বাচন হোক। উত্তরপ্রদেশ বা পশ্চিমবাংলার মতো বেশ কিছু দিন ধরে খেপে খেপে নির্বাচন হবে ফেজ ওয়ান, ফেজ টু। নির্বাচনী বুথ-এর মতো কলেজ প্রাঙ্গণ ঘিরে থাকবে পুলিশ। রক্তপাত একেবারে না হোক, কিছু তো বন্ধ হবেই। আশা করা যায় নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ।
আজ শুনতে পাই, সি পি এমের ছাত্র সংগঠন অভিযোগ করছে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেই দেওয়া হচ্ছে না, প্রার্থীদের ভয় দেখানো হচ্ছে, নামই দিতে পারছে না। কেমন যেন মনে হয়, এ বাক্যবন্ধগুলি খুবই চেনা, আগেও যেন শুনেছি। শুধু অভিযোগকারী আর অভিযুক্ত বদল হয়ে গিয়েছে। একেই কি বলে নিয়তির পরিহাস?
আমার শিক্ষকজীবনে ও সাংসদজীবনে শিক্ষাকে নানা রঙে রাঙিয়ে যেতে দেখেছি। এক সময়ে শিক্ষার গৈরিকীকরণ দেখেছি। আর আমার নিজের রাজ্যে তিন দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষার রং ছিল ঘোর রক্তিম বর্ণ। পার্লামেন্টারি জীবনে এলাকার উন্নতির জন্য যে ভাল রকম অর্থ পাওয়া যেত (এখন আরওই ভাল পাওয়া যায়), তার অধিকাংশ শিক্ষার খাতে ব্যয় করতাম। নির্বাচিত হয়ে গেলে জনপ্রতিনিধি সকলেরই যাঁরা ভোট দিয়েছেন তাঁদেরও যেমন, যাঁরা দেননি তাঁদেরও এই ধরনের সেকেলে বিশ্বাস থাকার ফলে বিরোধী পক্ষের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কখনও বঞ্চিত হয়নি, বরং অধিক পেয়েছে। আমার ক্ষুব্ধ কর্মীরা বলেছেন, ওদের দিলেন? ওখানে তো প্রিন্সিপাল থেকে চাপরাশি সব ওদের দলের হওয়া চাই। বোঝানোর চেষ্টা করেছি, প্রশ্ন প্রিন্সিপাল বা চাপরাশির নয়, ভাল হবে ছাত্রদের। তারা পড়াশুনো করে বুঝতে শিখবে কীসে তাদের মঙ্গল, তার পর নিজের পছন্দমত রাজনীতি বেছে নেবে। এই সব উপদেশ শুনে আমার যাদবপুরের কর্মী বলেছে, ‘দিদি যে কী কয়!’ দোষ দিতে পারি না। ভোটের দিন সকালে সেই কর্মীকে রাস্তায় দেখে বলি, এ কী, এখনও বুথে বসোনি? সে বলে, যাইতাছি তো, বাড়িতে বাজারটা দিয়া যাই। এরা প্রাণ দিয়ে খেটেছে, বেকার ছেলে, বাড়ির কাজ করতে হয়। ক্ষমতাহীন বিরোধী দলের কর্মী, মার খেয়েছে অপর পক্ষের হাতে। হিতোপদেশ ভাল লাগবার কথা নয়। |
পরিবর্তন? |
|
নির্বাচন। সাউথ সিটি কলেজ। ২১ ডিসেম্বর, ২০০৯ |
|
নির্বাচন। কৃষ্ণনগর উইমেনস কলেজ। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ |
|
অতঃপর? |
হঠাৎ করে পরিবর্তন বলে এক ঝড় উঠল। পরিবর্তন ঘটেও গেল। জনগণেশ প্রত্যাখ্যান করলেন পুরাতনকে, নিয়ে এলেন নূতনকে। নূতন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা নানাবিধ যে-সব ঘোষণা করলেন তার অন্যতম হল: ‘শিক্ষাকে আমি দলতন্ত্রমুক্ত করব। শিক্ষা থাকবে শিক্ষাবিদের হাতে। আমরা রাজনীতিকরা বা শাসকদল তাতে কখনও মাথা গলাব না।’ কী বলব! এই কথা বসন্তের বাতাসের মতো প্রাণের ’পরে চলে গেল।
তবু মারামারি বন্ধ হল না, অধ্যাপক নিগ্রহ বেড়েই চলল। গুঞ্জন উঠল ব্যর্থতার। দায় কার? দায় কিন্তু একা কোনও মুখ্যমন্ত্রীর নয়। গণতন্ত্রের নিয়মে আজ কেউ বিরোধী দলে, কাল তিনিই শাসক। শিক্ষাজগতে রাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হলে সকল পক্ষকে বলতে হবে, শিক্ষা থাকবে দলতন্ত্রমুক্ত। শুনেছি, মারামারির খবর করতে গেলে সাংবাদিকদের শুনতে হয়েছে, ‘আমরা যখন মার খেতাম, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?’ এ কথা বলার সুযোগ যেন কোনও দলই না পায়।
আজকাল জনগণ পরিণত হয়েছেন। শুধুমাত্র জাতপাতের ভিত্তিতে আর ভোট হয় না, মানুষ ডেভেলপমেন্টের কথা বলেন। আজকের সরকার যদি প্রতিশ্রুতি মতো দলতন্ত্রমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা দিতে পারে, জনগণের যদি মনে ধরে যায়, তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিকেও চিন্তা করতে হবে।
এই রকম সময়ে বিচারব্যবস্থা যা রায় দিলেন, তাতে কিন্তু সিলমোহর পড়ে গেল, শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে রাজনীতিক দলের হাতেই। তাই সাধারণ নির্বাচনের মতোই নির্বাচন কমিশনকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা কি তবে আত্মসমর্পণ করলাম? রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাজগৎ থেকে যাবে অলীক স্বপ্ন?
আমরা কী চেয়েছিলাম? শিক্ষার রং গেরুয়া হবে না, হবে না লাল বা সবুজ, এমনকি নীল! রং থাকবে শুভ্র, সাদা। পরিবর্তনের হাওয়া আশা এনেছিল ভোরের আলো ফুটবে। আদালত বলছেন বাস্তব অন্য রকম। ফয়েজ আহম্দ ফয়েজ মনে পড়ছে আমরা যার জন্য ইন্তেজার করেছিলাম, এ ভোরের আলো তা নয়, তা নয়। তবু বলব, আশাহত হওয়ার সময় আসেনি। এ রাজ্যের মানুষের সামনে, নবীন সরকারের সামনে সদিচ্ছা কাজে পরিণত করার যথেষ্ট সময় রয়েছে। ফয়েজ-এর কথাতেই বলতে হয়, মঞ্জিল যতক্ষণ না মিলবে, চলো, চলতে থাকি।
|
লেখক ভূতপূর্ব সাংসদ |
|
|
|
|
|