বঙ্গজন, প্রকৃতিগত ভাবে, ছুটি-প্রিয়। তৈলঢালা স্নিগ্ধতনু ছুটি পাইলে ছাড়িতে চাহে না। ছুটির অছিলাও ছাড়ে না। যে কেহই বন্ধ ডাকুক, যে কেহই সেই কর্মনাশ রুখিবার ডাক দিক, বন্ধমাত্রেই ‘সফল’ হয়। কারণ, সেই ‘ছুটি’। এই ছুটি-অন্ত-প্রাণ দেশে মুর্শিদাবাদ জেলার নসিপুর হাইমাদ্রাসার দৃষ্টান্তটি সত্যই এক বিরল ব্যতিক্রম। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বিদ্যালয়ে ‘ছুটি’ চলে। অথচ, সেই ছুটিই যে শেষ কথা নহে, চাহিলে তাহাকেও কর্মদিবস-এ রূপান্তরিত করা যায়, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাহাই প্রমাণিত হইয়াছে। প্রত্যন্ত গ্রামের এই মাদ্রাসার পড়ুয়াগণ তেমন সচ্ছল পরিবার হইতে আসেন নাই, বাড়িতেও পড়া দেখাইয়া দিবার যোগ্য ব্যক্তির অভাব, সুতরাং শিক্ষায়তন টানা কিছু দিন বন্ধ থাকিলে পাঠে বিঘ্ন ঘটিবার সম্ভাবনা বিস্তর। মুশকিল আসান হইলেন মাদ্রাসার শিক্ষকেরা। সন্ধ্যাবেলায় তাঁহারা মাদ্রাসারই কক্ষে পাঠদান শুরু করিলেন। কম্পিউটার, প্রজেক্টর ইত্যাদি সহযোগে রীতিমত মনোজ্ঞ করিয়া তুলিলেন সান্ধ্য-শিক্ষার আসর। যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এই মাদ্রাসা চলে, তাহার নিরিখে এই ধরনের কর্মকাণ্ড কার্যত নজিরবিহীন। ফল ফলিতে বিলম্ব হয় নাই। পড়ুয়াগণ মহানন্দে ‘ছুটি’ ফেলিয়া পাঠে শামিল। মাদ্রাসার শিক্ষকেরাও ‘বৈধ’ ছুটির সন্ধ্যায় কাজে মগ্ন। শিক্ষাক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হইল।
এই উদাহরণ হইতে পশ্চিমবঙ্গ কিছু শিখিবে কি? শিখিবার ইচ্ছা আছে কি? সংশয় অমূলক নহে। একটি অভিযোগ বহুশ্রুত, এবং বহুচর্চিত। কাজ হয় না। প্রশ্ন উঠে, কেন হয় না? উত্তর, পরিকাঠামো নাই, তাই। প্রশাসন অমুক জিনিসটি দেয় নাই, তমুক কাজটি করে নাই, তাই। ‘অমুক’ জিনিস এবং ‘তমুক’ কাজটি গুরুত্বপূর্ণ হইতেই পারে, কিন্তু তাহার অভাবে কাজকর্ম থামাইয়া বসিয়া থাকিতে হইবে কেন? দূর গ্রামের মাদ্রাসায় সান্ধ্যকালীন পাঠে ‘প্রজেক্টর’ চলিতেছে, পর্দায় দক্ষিণ মেরুর ছবি পড়ুয়ারা সবিস্ময়ে দেখিতেছে, সহসা শুনিলে ইহাকে রূপকথা বা সিনেমার কাহিনি বলিয়া ভ্রম হইতে পারে। নসিপুর হাইমাদ্রাসা এই আপাত অবিশ্বাস্য কথাটিকে বাস্তব করিয়া দেখাইয়াছে। এবং স্বীয় চেষ্টায়। অসম্ভবটিকে সম্ভব করিবার জন্য প্রশাসনের কৃপাপ্রার্থী হয় নাই। পরিকাঠামো নাই বলিয়া হাত গুটাইয়া থাকে নাই। কর্তব্যশীল নাগরিক সমাজের নিজস্ব প্রয়াস কত দূর যাইতে পারে, ইহা তাহারই উজ্জ্বল প্রমাণ।
পরিকাঠামোর অভাব নিশ্চয়ই দূর করা চাই। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই এই অভাব হইয়া দাঁড়ায় অবহেলা বা অকর্মণ্যতার অজুহাত। এই অজুহাতে কাজ যতটা হইতে পারিত, তাহাও হয় না। একটি দৃষ্টান্ত। শিশুশ্রমিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গে যে কয়টি বিদ্যালয় থাকিবার কথা, তাহা নাই। যে কয়টি আছে, তাহারও দশা অতি করুণ। রাজ্যে স্বীকৃত হিসাব অনুসারে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক। বিশেষ বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার নথিভুক্ত সংখ্যা পঁয়তাল্লিশ সহস্রের কিছু বেশি। মোট শিশুশ্রমিক-সংখ্যার দশ শতাংশও নহে। কেন এমন অবস্থা, প্রশ্ন উঠিলে, পরিকাঠামোর কথা উঠিবে। নাগরিক সমাজ কেন উদ্যোগী হয় নাই, প্রশাসনের বাহিরে থাকিয়াও কিছু করা যায় কি না, তাহার চেষ্টা কেন করা হয় নাই, সেই কথাগুলি কেহই ভাবিতে চাহেন না। এই মনোভাব সর্বত্র। ইহার পরিবর্তন জরুরি। নসিপুর হাইমাদ্রাসা একটি গুণগত পরিবর্তন আনিয়া দেখাইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গীয়গণ শিখিলে রাজ্যেরই মঙ্গল হইবে। |