বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সপ্তাহকাল কাটিয়া গিয়াছে। পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মণিপুর ও গোয়ায় কোন দল সরকার গড়িতেছে, কে মুখ্যমন্ত্রী হইতেছেন, সবই নির্ণয় হইয়া গিয়াছে। কিন্তু উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেস বিজেপির হাত হইতে শাসনক্ষমতা ছিনাইয়া লইয়াও এখনও মুখ্যমন্ত্রী স্থির করিতে পারিতেছে না। কারণ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তথা হাইকমান্ড ওই প্রদেশকে এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত লইতে দিতেছে না। ইহা কংগ্রেস দলের চিরাচরিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজ্যের রাজনীতিকরা ভোটে লড়িবেন, জনাদেশ লইয়া ক্ষমতায় আসীন হইবেন, কিন্তু তাঁহাদের পরিষদীয় নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রী স্থির করার অধিকার নাই। যাহাতে সে-অধিকার না থাকে, সে জন্যই নির্বাচনের পূর্বাহ্ণ হইতেই রাজ্যে-রাজ্যে এক জন ‘পর্যবেক্ষক’কে হাইকমান্ড মাথার উপর বসাইয়া দেয়। উত্তরাখণ্ডের জন্য পর্যবেক্ষক হইয়াছেন গুলাম নবি আজাদ। তিনি হাইকমান্ড তথা দলনেত্রীর বার্তাবহ হইয়া দেরাদুন-দিল্লি করিতেছেন।
বলা হইতেছে, এক জন ‘সর্বসম্মত’ মুখ্যমন্ত্রী পছন্দ করিতে গিয়াই এই বিলম্ব। এই সর্বসম্মতির ধারণাটির মধ্যেই তো গলদ রহিয়াছে। যদি পরিষদীয় নেতৃপদের একাধিক দাবিদার থাকেন, তবে তাঁহাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হউক। অধিকাংশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যাঁহার অনুকূলে রায় দিবেন, মুখ্যমন্ত্রিত্বে তাঁহারই অধিকার সকলের শিরোধার্য হওয়ার কথা, হাইকমান্ডেরও। হাইকমান্ড কিংবা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কাহাকে পছন্দ করে, সেটা কেন এ ক্ষেত্রে বিচার্য হইবে? গণতন্ত্রে তো এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই স্বাস্থ্যকর। ইহার পরিবর্তে উপর হইতে কাহাকেও প্রদেশ দলের মাথায় চাপাইয়া দিলে বরং তাঁহার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধদের ছুরি শানাইতে সুবিধা হয়, কারণ তাঁহার যোগ্যতার মাপকাঠি হইয়া পড়ে হাই কমান্ডের প্রতি আনুগত্য কিংবা তাঁহার উপর বর্ষিত হাইকমান্ডের আশীর্বাদ ও পক্ষপাত। ইহার ফলে তাঁহার নেতৃত্বের কোনও গণতান্ত্রিক বৈধতা গড়িয়া ওঠে না। তিনি হইয়া ওঠেন কেবল তাঁহার সমর্থকদের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু যদি হাইকমান্ডের মনোনয়নের পরিবর্তে খোলামেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়া তিনি পরিষদীয় নেতা নির্বাচিত হইতেন, তবে তিনি কেবল একটি গোষ্ঠীর নয়, সমগ্র দলের নেতা রূপে বৈধতা অর্জন করিতেন। এই বৈধতাই এক জন রাজনীতিকের গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচ। ইহাই তাঁহাকে স্বাধীন ভাবে রাজ্য ও রাজ্যবাসীর স্বার্থে নীতিগত ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত লইতে প্রাণিত করে। যাঁহার এ বৈধতা নাই, যিনি কেবল অনুগ্রহভাজন বলিয়া নেতা হইয়াছেন, ‘সর্বসম্মত’ মুখ্যমন্ত্রী হইলেও তিনি তাঁহার নিয়োগকর্তা অর্থাৎ মনোনয়নকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকেন, তাঁহাদের নির্দেশ বা অভিপ্রায় অনুযায়ীই রাজ্য চালাইতে বাধ্য থাকেন।
কংগ্রেসের এই অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিই প্রাদেশিক স্তরে দলে কোনও নেতাকে বিকশিত হইতে দেয় নাই, উত্তরপ্রদেশের দলীয় নির্বাচন পরিচালনা করিতে রাহুল গাঁধীকে দিল্লি-লখনউ করিতে হইয়াছে। রাজ্যস্তরে প্রভাবশালী নেতাদের গড়িয়া উঠিতে না দেওয়ার মধ্যে সম্ভবত হাইকমান্ডের কায়েমি স্বার্থ রহিয়াছে। কেননা একবার তাহা ঘটিতে থাকিলে হাইকমান্ডকে আর কেহ পুঁছিবে না। তাই ‘সর্বসম্মত’ মুখ্যমন্ত্রী মনোনয়নের শর্ত। এই সর্বসম্মতি একটি ভ্রান্ত এবং বিভ্রান্তিকর বন্দোবস্ত, কার্যত উপর হইতে একতরফা ভাবে হাইকমান্ডের অনুগৃহীত নেতাকে বসাইয়া দিবার ছল। প্রতিটি রাজ্যকে হাইকমান্ডমুখী করিয়া রাখার এই কৌশলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবিরোধী মনোভাবের ক্রিয়াও যথেষ্ট। শক্তিশালী কেন্দ্র এবং দুর্বল ও মুখাপেক্ষী রাজ্যের ব্যবস্থা অনেক কাল যাবৎ কংগ্রেসি নীতি, কোয়ালিশন রাজনীতির চলতি বাধ্যবাধকতাও যাহাকে পাল্টাইতে পারে নাই। উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেসের নির্বাচন-উত্তর পরিষদীয় শক্তি যে রূপ, মায়াবতীর বহুজনসমাজ পার্টির নির্বাচিত বিধায়কের নিঃশর্ত সমর্থনের পর তাহা যে সংহতি অর্জন করিয়াছে, তাহাতে কংগ্রেস অনায়াসেই এত দিনে মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করিয়া দিতে পারিত, গুলাম নবি আজাদকে ঘন ঘন সনিয়া গাঁধী সকাশে দৌড়াইতে হইত না। |