রবিবার বাড়ি থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হেফাজতে রেখেছিল পুলিশ। সোমবার তার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন বাবা এবং দাদু। কিন্তু ছ’বছরের ঋষিব্রত শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে, তা নির্ভর করছে শিশুকল্যাণ সমিতির রায়ের উপরেই।
ঋষিব্রতর দাদু, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রদ্যোৎ হালদার এবং তার বাবা শ্যামল মল্লিক দু’জনেই এ দিন সমিতির কাছে ওই শিশুকে নিজেদের কাছে রাখার আর্জি জানান। শিশু-সংক্রান্ত কোনও আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য এই সমিতি গঠিত হয়েছে। দু’জনের আর্জি শুনে আপাতত রায়দান স্থগিত রেখেছেন শিশুকল্যাণ সমিতির সদস্যেরা। তাঁরা জানান, শিশুটি এখন অসুস্থ। একটি হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। যত দিন না সে সুস্থ হচ্ছে, তত দিন এই মামলার শুনানি স্থগিত থাকবে। পরের শুনানির দিন ঠিক হয়েছে ২১ মার্চ। |
|
|
কান্নায় ভেঙে পড়েছেন
ঋষিব্রতর দাদু। |
কোর্টের পথে মা প্রিয়াঙ্কা মল্লিক। সোমবার। |
|
কার হাতে দেওয়া হতে পারে ঋষিব্রতর প্রতিপালনের ভার?
সমিতির সদস্যেরা জানিয়েছেন, সাধারণ ভাবে কোনও শিশুর প্রাথমিক অভিভাবক তার বাবা-মা। কিন্তু তাঁদের কাছে যদি শিশু ভাল না থাকে, তা হলে অন্য কোনও আত্মীয়ের কাছে পাঠানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শ্যামলবাবুকে লিখিত ভাবে সমিতিকে জানাতে হবে, এই ব্যবস্থায় তাঁর কোনও আপত্তি নেই। এ দিন সে জন্যই জামাইয়ের কাছে বারবার সাহায্যের আকুতি করতে থাকেন প্রদ্যোৎবাবু। তাঁর কথায়, “নাতি হওয়ার পরেই মেয়ে ওকে আমাদের কাছে রেখে গিয়েছিল। তিন বছরের জন্মদিনের আগে ওকে নিয়ে যায়। এর পরে নাতির কাছে গেলে আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত মেয়ে।”
কেন এমন করলেন প্রিয়াঙ্কা?
উত্তর জানা নেই ওই বৃদ্ধের। তিনি জানান, তাঁর একমাত্র মেয়ে, প্রিয়াঙ্কা এক সময় বেশ ভাল ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণির পরে হঠাৎই পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ২০০৫ সালে তিনিই মেয়ের সঙ্গে শ্যামলবাবুর বিয়ে দেন। ২০০৬ সালে জন্ম হয় ঋষিব্রতর। তার পর থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে থাকেন তার মেয়ে। দাদু-দিদার কাছেই বড় হতে থাকে ঋষিব্রত। ২০০৯ সালে জন্মদিন পালন করা হবে বলে প্রিয়াঙ্কা ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে যান। এর পরে প্রিয়াঙ্কা বাবা-মা’র সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন বলেও প্রদ্যোৎবাবু জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বছর খানেক আগে এক বার নাতিকে দেখতে যাই। কিন্তু মেয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। তখন দেখেছিলাম, নাতির সারা গায়ে মারধরের দাগ।” কথা বলতে বলতেই ফের কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধ। প্রদ্যোৎবাবু জানিয়েছেন, নাতির খবর জানার পর থেকে বাড়িতে কান্নাকাটি করছেন তাঁর স্ত্রীও। তিনিও নিজের কাছেই রাখতে চান একমাত্র নাতিকে।
অন্য দিকে শ্যামলবাবু জানান, প্রিয়াঙ্কা তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। আগের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। এর পরে তিনি প্রিয়াঙ্কাকে বিয়ে করেন। এখন প্রিয়াঙ্কার সঙ্গেও তাঁর বিচ্ছেদের মামলা চলছে। মামলা চলাকালীন শ্যামলবাবু নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে পাইকপাড়ায় তাঁর পৈতৃক বাড়িতে চলে যান। এর পরে বছর দেড়েক ধরে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে তাঁর আর কোনও সম্পর্ক ছিল না বলে তিনি জানিয়েছেন। আরও জানান, রবিবার ছেলেকে উদ্ধারের পরে পুলিশ তাঁকে খবর দেয়। এ দিন তিনি ছেলের দায়িত্ব নিতে চেয়ে সমিতির অফিসে হাজির হয়েছিলেন। ছেলেকে দাদুর হাতে তুলে দিতে রাজি হননি শ্যামলবাবু। তিনি বলেন, “আমি ছেলেকে আমার কাছেই রাখতে চাই।” কিন্তু এত দিন ছেলের খোঁজ নেননি কেন? সে প্রশ্নের অবশ্য কোনও উত্তর দিতে পারেননি তিনি।
শিশুকল্যাণ সমিতির সদস্যরা জানিয়েছেন, আইনে শিশুটির মতামতের গুরুত্ব অপরিসীম। তার মতামত শুনেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রবিবার চিৎপুর থানা এলাকার নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ের একটি বাড়ি থেকে ঋষিব্রত মল্লিক নামে ওই শিশুকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। তার সারা গায়ে ছিল ক্ষতচিহ্ন। মাথার চুল খাবলে তুলে নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশে অভিযোগ করেন, শিশুটির মা, প্রিয়াঙ্কা মল্লিক-ই তার উপরে অত্যাচার করেছেন। দিনের পর দিন তাকে ঘরে বন্দি করেও রেখে দিতেন তিনি। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার সন্ধ্যায় প্রিয়াঙ্কাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ছেলেকে মারধর, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা এবং বেআইনি ভাবে আটকে রাখার মামলা দায়ের করে।
সোমবার দুপুর পৌনে একটার সময়ে প্রিয়াঙ্কাকে শিয়ালদহ আদালতে হাজির করানো হয়। বাদামি রঙের ওড়নায় মুখ ঢেকে পুলিশ ভ্যান থেকে নেমে কোর্ট লকআপে ঢুকে যান তিনি। পরে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেন বিচারক। জামিনে মুক্তির পরেও অবশ্য ছেলেকে নিজের হেফাজতে পাননি প্রিয়াঙ্কা। তাঁর বাবা প্রদ্যোৎ হালদার এ দিন বলেন, “আমার মেয়ে যে কাজ করেছে, তাতে ওর কঠোর শাস্তি হলেই শান্তি পাব।”
|