উদ্যোগহীনতা ও রাজনৈতিক কলহের অভিযোগে কার্যত বন্ধ হতে বসেছে এনআরএস হাসপাতালের সদ্য শুরু হওয়া কমিউনিটি মেডিসিনের জেনারেল আউটডোর বিভাগটি।
হাসপাতালে ‘রেফার’ তকমা ছাড়া কোনও রোগী এলে তাঁকে দ্রুত পরিষেবার আওতায় আনার উদ্দেশ্যে বিভাগটির সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রায় সাড়ে চার মাস সফল ভাবে চলা সত্ত্বেও ২০১২-র জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ থেকে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় নতুন টিকিট দেওয়া। ফলে নদিয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম থেকে ‘রেফার’ ছাড়া আসা অসংখ্য রোগী হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে বিস্তর অভিযোগ মিলছে। এই নিয়ে শুরু হয়েছে বিভাগীয় চিকিৎসক ও প্রশাসনের মধ্যে কাজিয়া।
ওই হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিনের জেনারেল আউটডোরে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে নতুন টিকিটের সংখ্যা ছিল ১১,১৩৮। রোগীদের অভিযোগ, জানুয়ারির ১৭ তারিখ থেকে এই বিভাগের জন্য নতুন টিকিট দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তথ্য অনুসারে ১৭ ও ১৮ তারিখে ইস্যু করা চারটি টিকিটই ছিল অন্য দফতরের রেফারাল। এই মুহূর্তে পুরোনো টিকিটের রোগী নিয়ে টিম টিম করে চলছে বিভাগটি। যার সংখ্যা এসে ঠেকেছে দৈনিক ছ’টিতে।
ওই বিভাগের এক চিকিৎসকের মতে, উদ্যোগহীনতার ফলেই রোগী ও শিক্ষানবিশদের প্রয়োজনীয় কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ এই রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালে শুরু হল না। তাঁর দাবি, “২০০৩ সালে রাজ্যে প্রথম এই ব্যবস্থা চালু হয় ন্যাশনাল মেডিক্যালে। ২০০৭ থেকে সাফল্যের সঙ্গে এসএসকেএমে চলছে কমিউনিটি মেডিসিনের জেনারেল আউটডোর। এর থেকেই উৎসাহিত হয়ে এনআরএসে-ও চালু হয় ওই বিভাগ। অথচ বর্তমানে বিভাগের ১১ জন ফ্যাকাল্টির সরকারি মোটা মাইনের পরিবর্তে বরাদ্দ সাপ্তাহিক আড়াইটে ক্লাস আর ‘আড্ডা’র জন্য বিস্তর সময়।” তাঁর মতে, “দেখা গিয়েছে, ‘রেফার’ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে এলে রোগী বিভিন্ন বিভাগে ঠোক্কর খান। নিয়মের গেরোয় ঠিক চিকিৎসা পেতে বহু ক্ষেত্রে সপ্তাহখানেক কেটে যায়। সব থেকে বেশি ভোগেন শহরতলি ও গ্রাম থেকে আসা মানুষ।” এই দিকটি বিবেচনা করে এবং স্পেশালাইজ্ড আউটডোরগুলিতে চাপ কমাতে এনআরএসের কলেজ কাউন্সিল ও তৎকালীন সুপার লক্ষ্মীকান্ত ঘোষের সম্মতিতে শুরু হয় বিভাগটি।
বিভাগটির এই দশার জন্য অভিযোগের তির হাসপাতালের বর্তমান সুপার স্বপন সাঁতরার দিকে। কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান উচ্ছলকুমার ভদ্রের অভিযোগ, “জানুয়ারির ৬ তারিখে ডাক্তারদের কংগ্রেসি সংগঠন ন্যাশনালিস্টিক ডেমোক্র্যাটিক ফোরাম (এনডিএফ)-এর সেক্রেটারির হাতে ওপিডি ভবনের ডুপ্লিকেট চাবি তুলে দেওয়ার লিখিত আদেশ দেন সুপার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলে ৯ জানুয়ারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রদীপ ঘোষকে চিঠি দিয়েছিলাম। তাতে এই আদেশের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কিন্তু উত্তর পাইনি। অধ্যক্ষ চিঠিটি পাঠিয়ে দেন সুপারের কাছে। তারই প্রেক্ষিতে বন্ধ হয়েছে নতুন টিকিট ইস্যু করা।”
এই অভিযোগ অস্বীকার করে সুপার স্বপনবাবু বলেন, “মূলত নিয়ম ভেঙে চিকিৎসা করছিল ওই বিভাগ। ‘রেফার’ ছাড়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার পরে নির্দিষ্ট স্পেশালাইজ্ড আউটডোরে পাঠাচ্ছিল না। এতে বিরক্ত হন রোগী ও তাঁদের পরিবার। তাঁরাই নতুন করে টিকিট নেওয়া বয়কট করেছেন। বিভাগ বন্ধ করার আদেশ আমি দিইনি। এ ছাড়া কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগটি খুঁজে পেতে অসুবিধে হচ্ছিল অনেক রোগীর। সেটিও এই বিভাগ বন্ধ হতে বসার অপর কারণ।” এমনকী, এনডিএফ-এর সেক্রেটারির হাতে ওপিডি ভবনের চাবি দেওয়ার লিখিত আদেশের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, “এই রকম কোনও আদেশ করে চিঠি আমি দিইনি।” তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধ পক্ষের সমর্থনে একটি চিঠি হাতে আসার কথা জেনেও বিষয়টি অস্বীকার করেন স্বপনবাবু।
অন্য দিকে, চিকিৎসায় অনিয়মের প্রসঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দাবি, “সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দিচ্ছেন সুপার। রাজ্য সরকারের ‘স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন্স ফর প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার ফেসিলিটিস্’ অনুসরণ করে চিকিৎসা হয়েছে এখানে। বিভাগের অস্তিত্বের টানাপোড়েনে হাতেনাতে চিকিৎসা প্রণালী শেখার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ভবিষ্যতের জেনারেল ফিজিশিয়ানেরাও।” তাঁর প্রশ্ন, যদি কোনও বিভাগ খুঁজে পেতে রোগীরা সমস্যায় পড়েন, তবে কি একমাত্র সমাধান সেই বিভাগটিকে বন্ধ করে দেওয়া? রোগীদের বয়কটের প্রসঙ্গটি অবান্তর বলে মনে করছেন উচ্ছলবাবু। তিনি বলেন, “যেখানে ১৬ তারিখে নতুন টিকিট ইস্যুর সংখ্যা ছিল ৯৪, সেখানে ঠিক তার পরের দিন সংখ্যাটা শূন্য হওয়া অসম্ভব।” |