নষ্ট শৈশব ১ শিশুশ্রমের রমরমায়
‘দ্বিতীয়’ পশ্চিমবঙ্গ
বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ডকে টপকে গেল পশ্চিমবঙ্গ! উন্নয়নে নয়, শিশুশ্রমিকের সংখ্যায়।
খোদ জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার (ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন) ২০০৯-২০১০ সালের রিপোর্ট অনুয়াযী, শিশুশ্রমিকের সংখ্যার নিরিখে সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গের স্থান এখন দুই নম্বরে। উত্তরপ্রদেশের পরেই। বিহার, ওড়িশা বা ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যেও পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় শিশুশ্রমিক অনেক কম।
অথচ প্রতিবেশী এই তিন রাজ্য বহুদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গকে শ্রমিক এবং শিশুশ্রমিক সরবরাহ করে এসেছে। ইটভাটা, ধানকল, চটকল এবং অসংগঠিত নানা প্রকল্পে ভিন রাজ্যের শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বভাবতই এই নতুন রিপোর্ট একাধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
প্রতিবেশী রাজ্যগুলো যেখানে শিশুশ্রমিকের অনুপাত কমিয়ে ফেলেছে, পশ্চিমবঙ্গ সেটা করতে পারেনি কেন? ভিনরাজ্য থেকে যদি শিশুশ্রমিক আসা কমে গিয়ে থাকে, তাহলেও পশ্চিমবঙ্গ শিশুশ্রমিকের সংখ্যায় দু’নম্বরে কেন? তবে কি পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোতেই বাড়ছে দারিদ্রের প্রকোপ? বাড়ছে শিশুশ্রমের ব্যবহার?
রাজ্যের কোন অঞ্চলে, কী ধরনের কাজে শিশুশ্রমিকদের ব্যবহার বেশি, তার কোনও পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট কিন্তু নেই। কারণ, শিশুশ্রমের ব্যবহার বেশি মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রেই। তার মধ্যে চায়ের দোকান-রাস্তার হোটেল-ধাবার কাজ রয়েছে, বিড়ি বাঁধাই-বাজি তৈরির মতো কাজ রয়েছে। রয়েছে রেলস্টেশনে জুতো পালিশ, কাগজ কুড়োনোর কাজ। বাজি তৈরির কাজ দক্ষিণ ২৪ পরগণায় এক সময় বিপুল সংখ্যক শিশু কাজ করত। গত এক-দেড় বছরে ব্যাপক ধরপাকড়ের পর সেটা কিছুটা কমেছে বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের বিড়ি শিল্পে এখনও শিশুশ্রমের রমরমা। কলকাতা-সহ হলদিয়া, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ির মতো বড় শহরগুলির হোটেল-চায়ের দোকানে এবং বড় জংশন স্টেশনগুলিতে শিশুশ্রমের বাড়বাড়ন্ত। কলকাতা শহরের হোটেল বা চায়ের দোকানে যত শিশু কাজ করে, তাদের একটা বড় অংশ পূর্ব মেদিনীপুর থেকে আসে বলে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির মত।
বিশ্ব শ্রম সংস্থার ঠিক করে দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্কুলে যায় না এমন সব শিশুকেই সম্ভাব্য শিশুশ্রমিক ধরে নিয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করতে হবে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৫১ হাজার ৫৮৪। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, এই পরিসংখ্যানে কিন্তু চমকাচ্ছেন না তাঁরা। তাঁদের বরং বক্তব্য সর্বশিক্ষা অভিযান, একশো দিনের কাজ, শিশুপাচার সংক্রান্ত যে সব কেন্দ্রীয় রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, তার সব ক’টিতেই পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। এবং এই ক্ষেত্রগুলিতে পিছিয়ে থাকার অর্থই হল, শিশুশ্রমের বাড়বাড়ন্তের পথ প্রশস্ত হওয়া। ১০০ দিনের কাজে অগ্রগতি সংক্রান্ত রাজ্যওয়াড়ি তালিকায় (২০০৬-১০) পশ্চিমবঙ্গ ২৭ নম্বরে! সর্বশিক্ষা অভিযানের ‘শিক্ষা উন্নয়ন সারণি’তে (ইডিআই, ২০০৯) পশ্চিমবঙ্গ ২৬ নম্বরে! ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট (২০০৯) বলছে, দেহব্যবসার জন্য মেয়ে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনায় দেশের মধ্যে শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ!
মহাকরণ কী বলছে? রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর দাবি, এ সব কিছুই বাম সরকারের গাফিলতির ফল। তিনি বলেন, “বাম আমলে এ দিকটা পুরোপুরি উপেক্ষিত ছিল। তাই এ রকম হবেই। আমরা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেব।”
শ্রম দফতরের কর্তাদের কাছে অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট রোডম্যাপ নেই। রাজ্যে শিশুশ্রমিকের সাম্প্রতিক সংখ্যা কত, তা-ই জানা নেই তাঁদের। অথচ শিশুশ্রমিকদের পড়ার জন্য এ রাজ্যে জেলায় জেলায় মোট ৯৮৫টি বিশেষ স্কুল থাকার কথা। ৭২টি এখনও তৈরি হয়নি। দার্জিলিং জেলায় যেমন একটিও এ ধরনের স্কুল নেই। বাকি জেলার স্কুলগুলির পরিকাঠামোও সন্তোষজনক নয় বলে শ্রম দফতরের এক অফিসার জানান। কেন?
রাজ্যের শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি শ্রম কমিশনার সুমিতা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “১৫০০ টাকা বেতনে শিশুশ্রমিকদের স্কুলে শিক্ষক পেতে সমস্যা ছিল। গত এপ্রিল থেকে পরিমাণটা বাড়িয়ে ৪ হাজার করা হয়েছে।” কিন্তু টাকা পাঠাতে কেন্দ্র দেরি করছে বলে শ্রম দফতরের অভিযোগ। কিন্তু যে রাজ্যে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ৫ লক্ষের বেশি, সেখানে রাজ্যের হিসেবই বলছে, বিশেষ স্কুলের মোট পড়ুয়ার সংখ্যা ৪৫ হাজার ২৮১ জন। বিশেষ স্কুলের কার্যকারিতা তা হলে কতটা, ধন্দ রয়েছে দফতরের অন্দরেই।
শ্রম দফতরের অতিরিক্ত কমিশনার পশুপতি ঘোষ জানালেন, গত বছর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় স্কুলে শিশুশ্রমিকদের পূর্ণ সময় ধরে রাখতে স্কুলকে ‘আবাসিক’ স্তরে উন্নীত করতে হবে। ইতিমধ্যে সাতটি জেলায় এ রকম আবাসিক স্কুল করা গিয়েছে। উত্তর দিনাজপুর, বর্ধমান, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগণা ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে। কিন্তু শিশুশ্রমিকদের জন্য জাতীয় শিশুশ্রমিক প্রকল্পের (এনসিএলপি) রূপায়ণে অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ। রাজ্য শিশু সুরক্ষা সমিতি বা এসসিপিএস-ও কার্যত নিষ্ক্রিয়, এমন অভিযোগ অনেক মহলেই।
মহারাষ্ট্রের কিছু জেলাকে রাজ্য সরকার শিশুশ্রমিকমুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে। এ রাজ্যে কেন এ রকম চেষ্টা হচ্ছে না? পশুপতিবাবু বলেন, “এ রকম সিদ্ধাম্ত হয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে। সম্প্রতি দিল্লির বৈঠকে গিয়ে দেখেছি মহারাষ্ট্রের মুখ্যসচিব নিজে এ ব্যাপারে ভয়ানক আগ্রহী।” পশ্চিমবঙ্গ সেই আগ্রহটা কবে দেখাবে?

সহ প্রতিবেদন: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.