ফিলিপিন্স-২ (ফিলিপ ইয়ংহাসব্যান্ড-২)
ভারত-০
|
এক পেনাল্টি বক্সের অর্ধবৃত্তাকার লাইন থেকে অন্য পেনাল্টি বক্সের অর্ধবৃত্তাকার লাইন।
একটা সাদা লাইনের ও-পারে ভাইচুং ভুটিয়া ছটফট করছেন না। একটা সাদা লাইনের ও-পারে সুব্রত পাল চেঁচাচ্ছেন না।
কাঠমান্ডুর ভারতকে দেখে বারবার মনে পড়ছিল ওই দুটো মুখ।
ওই দুটো সাদা লাইনের মাঝখানের জমিতে রবিবার অধিকাংশ সময় বল পজেশন মানেই ছিল ভারত। কিন্তু জেতার জন্য যে ‘চল মেরে আসি’ মনোভাবটা দেখাতে হয়, তা আস্তিন থেকে বের করার লোক নেই নতুন প্রজন্মের। দুটো ভাল শট ভারতের বক্সে গেলদুটোই গোল। আর আমরা? অনেক উন্নতি দেখিয়ে, অনেকবার ডিফেন্সিভ থার্ড পর্যন্ত পৌঁছেও গোল হল না। বল পজেশন দিয়ে তো স্কোরলাইন লেখা হয় না! লেখা হলে, ভারত জিতত।
কাঠমান্ডুতে রোদ উঠলেই দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বসে দেখা যায়, সবুজ পাহাড়ের পিছনে বরফঘেরা স্বর্গীয় পাহাড়। ভারতের ফুটবলে রোদ উঠল না। স্বর্গীয় কিছু দৃশ্যও তৈরি হল না। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মঙ্গলবারের ম্যাচ এখন অর্থহীন। বিদায় এ এফ সি চ্যালেঞ্জ কাপ।
|
প্রথম অভিযানেই
ব্যর্থ নতুন নেতা। |
খেলার শুরু থেকেই গ্যালারিতে শ’খানেক ফিলিপিনো চেঁচাচ্ছিল। আমাদের বাংলায় যে সুরে মিছিলে ‘এক হও এক হও’ স্লোগান ওঠে, অনেকটা ও রকম ঢঙে চিৎকার। দশ মিনিটের ভিতরে চেলসি অ্যাকাডেমির ফসল ফিলিপ ইয়ংহাসব্যান্ড একটা গোল করে গেলেন রক্ষণ ও কিপার করণজিতের ভুল বোঝাবুঝিতে। তার পরে আবার তিয়াত্তর মিনিটে। ইয়ংহাসব্যান্ডরা দুই ভাই ফিলিপ ও জেমস ফিলিপিনোদের নতুন ইতিহাস রচনায় বড় ভূমিকা নিলেন। বাবা ইংরেজ, মা ফিলিপিনো এঁদের।
ফিলিপিন্সের প্রথম দলে দু’জন ইংল্যান্ডের ক্লাবের ফুটবলার, একজন নেদারল্যান্ডস, আমেরিকার। দু’জন ইংল্যান্ডের ক্লাবে খেলতেন। দু’জন স্পেনে বড় হয়েছেন। একজন আমেরিকায়। দু’জন মাত্র ফিলিপিন্সে বড় হয়েছেন। রিজার্ভ বেঞ্চে আরও ‘বিদেশি’। এ সব শুনলে যেমন আতঙ্ক হয়, তাদের ফুটবল তেমন দানা বাঁধেনি একসঙ্গে প্র্যাক্টিসের অভাবে। যৌন কেলেঙ্কারির চাপে দলটা রীতিমতো গুটিয়ে। তবু ভারতের বিরুদ্ধে তাঁরা এই প্রথম জিতে কেলেঙ্কারির ফাঁসটা কিছুটা আলগা করলেন। তাঁদের জার্মান কোচ হান্স মিচেল ওয়েস আগের দিন ম্যানিলার কাগজে বলেছিলেন, তিন গোল দিতে চাই ভারতকে। একটা গোল কম হল।
শান্ত স্যাভিও মিদেইরা এমন কোচ যে, প্রচলিত চিন্তার বাইরে যাবেন না। চেনা ছক। গোল হচ্ছে না দেখে, মাঝমাঠে নবিকে তুলে আনা যায়স্যাভিও ওই পথে যাবেন না। মাঝমাঠে লোক বাড়িয়ে ৪-৫-১ ছকে যাওয়া যায় শুধু সুনীলকে সামনে রেখেস্যাভিও ওই পথে যাবেন না। খেলতে খেলতে মাঝমাঠের কম্বিনেশন বদলে দেওয়া যায়স্যাভিও ওই পথে যাবেন না। ওই যে গুরু বব হাউটন শিখিয়ে গেছেন, ৪-৪-২ ছকেই মোক্ষ! ছাত্র যখন বলেন, তাঁর পরিকল্পনায় ফিট করে না বলে মেহতাব হোসেন, স্টিভন ডায়াসকে নেওয়া যায় না, তখন খারাপ লাগে।
আগের দিন নেপাল হারছিল দেখে, তাদের ব্রিটিশ কোচকে উপেক্ষা করে ভি আই পি বক্স থেকে ফুটবলার পাল্টাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট গণেশ থাপা। ক্ষিপ্ত ব্রিটিশ কোচ বেরিয়ে যাচ্ছিলেন বেঞ্চ থেকে। এ নিয়ে হইচই নেপাল ফুটবলে। এআইএফএফের প্রেসিডেন্ট কোনও ফুটবলার হলে আজ কি গণেশ থাপার মতোই করতেন? করেও লাভ ছিল না। একসঙ্গে এত সিনিয়রকে বসিয়ে দেওয়ায় এই দলটায় ‘বিস্ময়কর উপাদান’ই নেই।
ম্যাচটা জেতার পরে, ফিলিপিন্সের জার্মান কোচ ওয়েস বলে গেলেন, “হাউটনের ব্রিটিশ স্টাইলে লং বল থেকে সরে ভারতের পাসিং ফুটবলে ফেরা উচিত।” একেবারে আদর্শ পর্যবেক্ষণ। এই ম্যাচটায় বিপক্ষ টিম লম্বা ফুটবলারে বোঝাই দেখেও মাঝমাঠ একই রকম লং বল খেলে গেল। অ্যাটাকিং থার্ডে পৌঁছে কোনও বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা দেখাতে পারল না। নবি এবং সমীর, দুই প্রান্ত দিয়ে উঠলেই কিছুটা ঝকঝকে দেখাচ্ছিল দলকে। সুনীল ছেত্রী এখনও পুরো ফিট নন, স্যাভিও নিজেই বললেন। মাঝমাঠ থেকে মনোমত বল না পেয়ে অনেকটা তলায় নেমে আসছিলেন অধিনায়ক। সামনে তো আবার লোক কমে গেল। শেষ দিকে সুনীল-সুশীল বোঝাপড়া থেকে একটা গোল হয়ে যাচ্ছিল। সারা ম্যাচে ওই একটাই সুযোগ।
ভারতের স্টপার জুটি নতুন। ফরোয়ার্ড জুটি নতুন। মিডফিল্ড নতুন। এই পরিস্থিতি থেকে নতুন প্রজন্মের দলকে টেনে তোলার মতো নেতার অভাব। সুনীল আগের দিন বলছিলেন, “আমাদের দলে তাতানোর জন্য চেঁচামেচি হচ্ছে না। সেটা পাল্টাতে হবে।” চেঁচানোর জন্য গোলকিপার করণজিৎকে শুধু চোখে পড়ল। তাও সেটা প্রথমার্ধে। ফুটবলে বলা হয়, টিমে দুটো লিডার দরকার। পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে খেলতে ছক পাল্টানোর লিডার। এবং চেঁচিয়ে দলকে তাতানোর মতো লিডার। ভারতের দুটোই ছিল না।
গোল তৈরির লোক নেই। গোল করার লোক নেই। মাঠে নেতৃত্ব দেওয়ার লোক নেই। পরিস্থিতি দেখে, টানাটানির সংসার ঠিক চালিয়ে দেওয়ার কোচও নেই। তিনি বড্ড শান্ত, ভাল মানুষ।
এই দুর্দশা ও লজ্জা এই ভারতের প্রাপ্যই ছিল।
|
ভারত: করণজিৎ, সমীর, রাজু, গৌরমাঙ্গি, নবি, ভাসুম (সুশীল), আদিল (জুয়েল), ফ্রান্সিসকো, রোকাস, জোয়াকিম, সুনীল। |