বিরাট কোহলি মানে যে শুধুই মাঠের ক্রিকেট আর মাঠের বাইরের হুল্লোড়বাজ, পার্টিতে মত্ত, বিতর্কপ্রিয়, নৈশজীবনে উড়তে থাকা কোনও তেইশ বছরের তরুণ নয়। তাঁর ভেতরে যে বসবাস করছে এক গভীর চিন্তাশীল, পরিণত ব্যক্তিও সেটা তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বেরিয়ে এল। ভারতীয় দলের নতুন সহ-অধিনায়ক, যিনি নতুন যাত্রা শুরু করছেন এশিয়া কাপ থেকে, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে। সহ-অধিনায়ক হওয়ার পর তাঁর দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার।
|
প্রশ্ন: সহ-অধিনায়ক বিরাট কোহলির পাল্টে যাওয়া মননটা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম...
কোহলি: (অবাক) পাল্টে যায়নি তো! এই তো বাড়িতে পাঁচ-ছ’টা দিন কাটিয়ে এলাম। চেনাশুনো যার সঙ্গে দেখা হয়েছে, আগেও যেমন দেখা হলে কথা হত এখনও তাই হচ্ছে। ভারতীয় দলের ভাইস ক্যাপ্টেন্সি নিশ্চয়ই আমার কাছে বিরাট সম্মান। কিন্তু এর জন্য মানুষ হিসেবে কোনও পরিবর্তন আসুক, চাই না।
প্র: আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সহ-অধিনায়কত্ব পেয়ে আপনার প্রতিক্রিয়াটাও এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। কী ছিল সেই প্রতিক্রিয়া তাই এখন জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে।
কোহলি: ২৩ বছরে ভাইস ক্যাপ্টেন্সি! খবরটা প্রথমে শুনে অবাক হওয়া আর প্রচণ্ড খুশি মিলিয়ে-মিশিয়ে যে প্রতিক্রিয়াটা হয় সেটাই হয়েছিল। আর মনে হয়েছিল, এই পদের একটা গুরুদায়িত্ব আছে। আমাকে সেটা রক্ষা করতে হবে।
প্র: এই যে রাহুল দ্রাবিড়ের অবসর ঘোষণা। অথবা সচিন তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরি নিয়ে হইচই। এ সব ঘটনা যখন ঘটে তখন একই ড্রেসিংরুমে থাকতে থাকতে আপনার মতো কোনও তরুণ ক্রিকেটারের মনের ভিতরে কী চলে?
কোহলি: আমি যখন ছোট ছিলাম, সারাক্ষণ স্বপ্ন দেখতাম দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলব। আর রাহুল ভাই, সচিন তেন্ডুলকর ছিল আইডল। তাদের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুম শেয়ার করতে পারব এটা কখনও ভাবিইনি। তাই ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ওদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে পারাটাই একটা স্বপ্ন সফল হওয়ার মতো ব্যাপার। এত কাছ থেকে এই কিংবদন্তিদের দেখা, তারা কী ভাবে কত পরিশ্রম করে নিজেদের তৈরি করে, কী ভাবে সাফল্যকে সামলায়, কী ভাবে ব্যর্থতা থেকে নিজেকে টেনে তোলে।
প্র: রাহুল দ্রাবিড়ের অবসর ঘোষণা থেকে কী শিক্ষা নিতে পারেন তেইশ বছরের বিরাট কোহলি?
কোহলি: রাহুল দ্রাবিড়ের অবসর থেকে এই শিক্ষাটাই তো নেওয়ার যে, সম্মান নিয়ে কী ভাবে চলে যাওয়া যায়। যাতে পিছন ফিরে তাকিয়ে লোকে বলে, ওফ্! কী ক্রিকেটার ছিল রে! কী কেরিয়ার! অলটাইম গ্রেটদের একজন!
প্র: ক্রিকেটের বাইরে এমন কেউ আছে, যে আপনাকে খুব উৎসাহিত করে? অনুপ্রেরণা যোগায়?
কোহলি: লান্স আর্মস্ট্রং। যাঁর কাহিনি পড়লে জানা যায় কী ভাবে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেও ফিরে এসে উইনার হিসেবে থেকে যাওয়া যায়। আমাদের যুবরাজ সিংহ। যে ভাবে একই রোগের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত, যুবরাজ ক্রিকেটের আর্মস্ট্রং হয়ে ফিরে আসবে। আর এক জন আছে। আয়ার্টন সেন্না।
প্র: বলা হচ্ছে, হোবার্টে আপনার ১৩৩ নানা কারণে ভারতীয় ওয়ান ডে ক্রিকেটের ইতিহাসে সবথেকে প্রভাবশালী ইনিংসগুলোর একটা। আপনার কেরিয়ারেও নতুন হাইওয়ে খুলে দিচ্ছে। আপনার কী মনে হচ্ছে?
কোহলি: অবশ্যই ওই ইনিংসটার পর নিজেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী লাগছে। কারণ ইনিংসটা টিমের খুব কঠিন একটা সময়, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় এসেছিল। আমার নিজের জন্যও হোবার্টের ১৩৩ খুব দামি। কিন্তু আমি এ ভাবে ভাবছি না যে, এই ইনিংসটা আমার কেরিয়ারকে দারুণ কোনও শৃঙ্গে বসিয়ে দিয়ে গেল। সেই শৃঙ্গটায় উঠতে গেলে এর পরেও টানা পরিশ্রম করে যেতে হবে। নিজের মনকে তাই দ্রুত বুঝিয়েছি, ফিরে যাও ওই ইনিংসটা খেলার আগের পরিস্থিতিতে। যখন নিজে নিজেকে বলছিলে, বড় ইনিংস খেলতে হবে বিরাট... ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলতে হবে।
প্র: হোবার্টের ১৩৩-ই কি আপনার জীবনের সেরা ইনিংস?
কোহলি: সেরা ওয়ান ডে ইনিংস। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে বেশি আদরের হচ্ছে পার্থে করা টেস্ট সেঞ্চুরিটা। প্রথম দু’টো টেস্টের পর বলে দেওয়া হয়েছিল আমি টেস্ট ক্রিকেটের অযোগ্য। এ রকম একটা কঠিন সফরের মধ্যে যখন কোনও কিছুই ভাল যাচ্ছিল না, যখন নিজেকে মানসিক ভাবে খুব আহত লাগছিল, তখন স্রোতের মুখটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পেরে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। ঈশ্বর করুণাময়!
প্র: মাঝেমধ্যে অনেক বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন। এটা আপনার আর একটা দিক। অস্ট্রেলিয়াতেই যেমন দর্শকদের সঙ্গে ঝামেলা লেগেছিল। প্রচুর বিতর্কও হয়েছিল আপনার সেই আঙুল দেখানোর ঘটনা নিয়ে...
কোহলি: আমার ভুল হয়েছিল ওই ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোটা। এটা স্বীকার করতে আমার এতটুকু অস্বস্তি নেই। আসলে আমি সেই সময়টা বড্ড বেশি ভাবছিলাম। পরে বুঝেছি যে, জীবনে সফল হতে গেলে এগুলো থেকে সুইচ অফ করা শিখতে হবে। সমালোচনা হবে। গালিগালাজও লোকে করবে। সে সব শুনেও তোমাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। পাখির চোখ করতে হবে তোমার ক্রিকেটকে। বাকি সব কাউন্টার বন্ধ করে দিতে হবে। প্রথম দু’টো টেস্টের পর আমি ঠিক সেটাই করেছিলাম। শুধু ক্রিকেট নিয়ে ভাবছিলাম। আমাকে ওরা কী ভাবে আউট করে যাচ্ছে। সেই জায়গাটা আটকে ওদের বোলারদের কী করে আমার শক্তির জায়গায় বল করতে বাধ্য করব।
প্র: বিশেষ ভাবে কারও সাহায্য পেয়েছিলেন ওই সময়?
কোহলি: টিমের সিনিয়রদের সঙ্গে রোজই কথা বলতাম। কিন্তু কী জানেন তো, দিনের শেষে নিজের সমস্যাটা নিজেকেই মেরামত করতে হবে। কারণ সমস্যাটা তো আমার ব্যাটে ছিল না, ছিল মাথায়। আমি ভুল দিকে নিজের ভাবনাকে চালিত করছিলাম। তাই উপদেশ নাও, কিন্তু একই সঙ্গে আত্মসমালোচনাটাও করতে হবে।
প্র: কিন্তু এই যে সিডনি-বিতর্ক, সেগুলো তো আপনার ভাবমূর্তির উপরও সাংঘাতিক প্রভাব ফেলে। সে সব নিয়ে আত্মসমালোচনা করেন?
কোহলি: করি বলেই তো বলছি, ওই কাজটা করার জন্য আমার আক্ষেপ হচ্ছে। আসলে পরে বুঝেছিলাম, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম দু’টো টেস্টে টার্গেট করেই আমাকে তাতানো হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় গেলে এগুলো ফেস করতে হবে। রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় হাঁটছি অথবা কোনও দোকানে ঢুকেছি, লোকে এসে কাউন্টিংয়ের মতো বলে যাচ্ছে, ওয়ান নিল..টু নিল..থ্রি নিল। আপনার কাজ হবে ওদের একেবারে অবজ্ঞা করা। আমি প্রথম দু’টো টেস্টে সেটা পারিনি। কিন্তু পরে তাই করেছিলাম।
প্র: আর এক বার জিজ্ঞেস করি, ভাইস ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলি কি পাল্টে ফেলবে নিজেকে?
কোহলি: যদি ক্রিকেটার কোহলির কথা জিজ্ঞেস করেন, উত্তর হচ্ছে ‘না’। একই রকম আক্রমণাত্মক ক্রিকেটার থাকব। জেদি থাকব। যদি মানুষ বিরাট কোহলির কথা জিজ্ঞেস করেন তা হলে বলব ‘না’। যদি ইমেজের কথা তোলেন, তা হলেই একমাত্র বলব ‘হ্যাঁ’। নিজেকে বলতে শুরু করেছি, এখন তুমি দেশের ভাইস ক্যাপ্টেন। এমন কিছু কোরো না যাতে তোমার টিমের, দেশের খারাপ বিজ্ঞাপন হয়। কোনও কোনও সময় আমি সীমানা অতিক্রম করে গিয়েছি। সেটা বন্ধ করতে চাই। কী দরকার ও সবের! |