দিনের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটে গুয়াহাটি শহরে রিকশা টেনে। ‘এই রিকশা’ বলে তাচ্ছিল্যের ডাক দেয় লোক জন। সেই রিকশাওয়ালাকেই আগরতলা বইমেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চে দেখা গেল মন্ত্রী-আমলা-নামী সাহিত্যিক ও সমাজে বিশিষ্টজনেদের সঙ্গে একাসনে। না, কারও অনুগ্রহে নয়, কবিত্বের জোরে। এ জন্যই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব কবি বলভদ্র দাস। রিকশার হাতল ধরা শক্ত হাতেই যিনি কবিতা লেখেন। যে কবিতার প্রতিটি অক্ষরে তাঁর নিজের কঠোর জীবনের কান্না-ঘাম-রক্তের মরমী ছবি।
নিতান্তই দরিদ্র ঘরের ছেলে। অর্থাভাবে পড়াশোনা ক্লাস এইটের পর আর এগোয়নি। বছর কুড়ি আগে বরপেটার অজ পাড়াগাঁ থেকে বলভদ্র পেটের তাগিদেই এসেছিলেন শহর গুয়াহাটিতে। পেটে খিদে, কিন্তু তার মধ্যেও কবিতার পোকা তাড়িয়ে বেড়াত তাঁকে। ‘ভদ্রস্থ’ কোনও কাজ জোটেনি। অগত্যা রিকশা চালাতে শুরু করলেন। কিন্তু কবিতা তাকে ছাড়েনি। রিকশা চালাতে চালাতেই এক দিন লিখে ফেললেন ‘মুর লক্ষ্য’। সেই কবিতা আর প্রথম মাসের রোজগার ১৮০০ টাকা বাবাকে পাঠিয়ে দিয়ে বড় শান্তি পেয়েছিলেন।
সেই থেকে রিকশাই বলভদ্রের অন্নদাতা। পাশাপাশি চলেছে কবিতা লেখাও। আর গান। ভূপেন হাজরিকার পরম অনুরাগী বলভদ্র রিকশা চালাতে চালাতেই গান করেন। আর নিজের চোখের সামনে যা দেখেন, তা তুলে রাখেন হৃদয়ে। দিনের শেষে ক্ষণিক অবসরে সেই দেখা, সেই অনুভূতিই কলমের আঁচড়ে রূপ নেয় কবিতায়। কেমন সে কবিতা?
“মহানগরর ফুলাম পথর
রিকশাওয়ালা আমি
বদ-বরষুণত রিকশা চালাও
শরীর ঘামি জামি”।
|
বলভদ্রের সব কবিতাতেই জড়িয়ে তাঁর স্পন্দিত জীবন। কখনও ঘর ছাড়ার বেদনা, কখনও পরিবারে অশান্তি, কখনও চোখের সামনে দেখা হত্যালীলা (২০০৮ সালে গণেশগুড়ি বিস্ফোরণ) ছন্দবন্দি হয় খাতায়। বলভদ্রের নিজের কথায়, “কবিতা লিখে বা গান গেয়ে কিছু অর্জন করতে চাইনি, এ আমার বাঁচার খোরাক।” স্ত্রী অলকা দাস, দুই সন্তান বিষ্ণুজ্যোতি, হরজ্যোতিকে নিয়ে গ্রামেই থাকেন। অলকা দেবী স্বামীর কাব্যচর্চায় বরাবরই উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন।
তবে, বলভদ্রের কবি পরিচয় আড়ালেই থেকে যেত যদি না আকাশবাণীর গীতিকার-অভিনেতা দিলীপ ফুকন তাঁর রিকশায় চড়তেন। বলভদ্রের গান শুনে, কবিতা পড়ে মুগ্ধ দিলীপবাবু তাঁকে নিজের হেঙরাবাড়ির বাড়িতে আশ্রয় দেন। সেই থেকে, গণেশগুড়ির রিকশাওয়ালা-কবির ঠিকানা সেটিই। পরে, সাহিত্য সভার উপ-সভাপতি পদুমী গগৈ ও অভিনেত্রী চেতনা দাসের উৎসাহে বলভদ্র এক দিন বই ছাপার কথা ভাবলেন। কিন্তু, টাকা কোথায়?
এগিয়ে এলেন লেখক-প্রকাশক সৌমেন ভারতীয়া। কেনও অর্থ না নিয়ে পরম যত্নে প্রকাশ করলেন বলভদ্রের ৫০টি কবিতার সঙ্কলন ‘সরু পথিক, দুখর পথিক’ (তুচ্ছ পথিক, দুঃখের পথিক)। গত ডিসেম্বরে সেই বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সাহিত্যিক হোমেন বরগোহাঞি ও ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী অনিল সরকার। বলভদ্রের কবিতার প্রতি অনুরাগ দেখে ও তাঁর কণ্ঠে ভূপেন হাজরিকার গান শুনে সকলেই মুগ্ধ। অনিলবাবু মঞ্চেই ঘোষণা করে দেন, আগরতলা বইমেলায় বলভদ্রবাবুকে নিয়ে যাবেন তিনি।
তখনও বিশ্বাস হয়নি বলভদ্রের। তাঁর কথায়, “মন্ত্রীরা তো অমন অনেক কথাই বলেন। কিন্তু, যে দিন শুনলাম ত্রিপুরা সরকার বিমানের টিকিট পাঠিয়েছে, বিহ্বল হয়ে পড়লাম। ত্রিপুরা সরকারের আমন্ত্রণে, সরকারি খরচে, জীবনে প্রথমবার বিমানে চাপা। তার পর ২৯ ফেব্রুয়ারি ৩০তম আগরতলা বইমেলায় বিশেষ সরকারি অতিথি হয়ে মন্ত্রী, আমলা, বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে এক মঞ্চে...। এই স্বীকৃতি, এত সম্মান পাব, সত্যিই ভাবিনি।”
স্বীকৃতি তো এল। এখনও কি রিকশা চালাবেন? কবির চোখটা নিমেষে জ্বলে উঠল। জবাব দিলেন, “শত প্রতিকূলতাতেও কবিতা লেখা যেমন ছাড়িনি, তেমনই ছাড়ব না রিকশার হাতলও। “পরিচিতি, সম্মান, প্রথম বিমানে চড়া--সবই তো এই রিকশার দৌলতে।” |