জানলা খুলতেই বছর ছয়েকের শিশুটির ভয়ার্ত মুখ। আধো অন্ধকার ঘরে চুপ করে দাঁড়িয়ে। মাথায়, মুখে অত্যাচারের চিহ্ন।
রবিবার চিৎপুর থানার নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ের একটি বাড়িতে ওই শিশুকে ‘উদ্ধার’ করতে গিয়ে এমনটাই দেখলেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ অফিসারেরা। পুলিশ সূত্রের খবর, শনিবার সন্ধ্যায় নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ের কয়েক জন বাসিন্দা থানায় অভিযোগ করেন, প্রিয়াঙ্কা মল্লিক নামে এক মহিলা তাঁর শিশুপুত্রকে নৃশংস ভাবে মারধর করে বাড়িতে আটকে রেখেছেন। স্থানীয় সূত্রে খবর, রবিবার সকালে কয়েক জন বাসিন্দা বাচ্চাটিকে উদ্ধার করতে যান। খবর পেয়ে হাজির হয় পুলিশও। পুলিশ জানিয়েছে, বাড়িটি তালা দেওয়া ছিল। তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ঋষিব্রত মল্লিক নামে ওই শিশুটিকে উদ্ধার করে আর জি করে নিয়ে যাওয়া হয়। শিশুটি পুলিশকে জানিয়েছে, খড়দহ রামকৃষ্ণ মিশনে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে সে।
পুলিশ জানায়, এ দিন সন্ধ্যায় শিশুটির মা প্রিয়াঙ্কা মল্লিককে গ্রেফতার করা হয়। রাতে তাঁকে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে পাঠায় পুলিশ। শিশুটি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আশ্রয়ে রয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, বাচ্চাটির মাথার একাধিক জায়গা থেকে চুল খুবলে তুলে নেওয়া হয়েছে। মাথার চামড়ায় ঘা হয়ে গিয়েছে। গায়ে ধারালো বস্তুর আঘাত রয়েছে। মারধরের চিহ্ন সারা গায়ে। ঋষিব্রত জানিয়েছে, মা-ই তাকে মারধর করেছেন। তার কথায়, “ইংরেজি কবিতা মুখস্থ করতে না পারলে এ রকম মার খেতে হয়, মা বলেছে।” |
ক্ষতবিক্ষত মাথা। উদ্ধারের পরে ঋষিব্রত। রবিবার। —নিজস্ব চিত্র |
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বছর পাঁচেক আগে শ্যামল মল্লিক এবং প্রিয়াঙ্কা ওই বাড়িতে ভাড়া আসেন। বছরখানেক আগে, শ্যামল বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে ছেলেকে নিয়ে একাই থাকতেন প্রিয়াঙ্কা। মাস কয়েক ধরে প্রায়ই ছেলেকে নৃশংস ভাবে মারধর করতেন তিনি। সকালে তালা দিয়ে ছেলেকে রেখে বেরিয়ে যেতেন। ফিরতেন গভীর রাতে। স্থানীয়েরা জানান, তাঁরা প্রিয়াঙ্কাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তিনি শোনেননি। ওই দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে বলে জানায় পুলিশ।
প্রিয়াঙ্কার পাশের ঘরেই ভাড়া থাকেন ইউনিস গিলকার নামে এক কাশ্মীরি যুবক। তিনি বলেন, “দু’-তিন দিন আগে মাঝরাতে ছেলেটির কান্নার শব্দ পাই। আগেও মারধর করতে দেখেছি। কিন্তু সে দিনটা ছিল ভয়ঙ্কর।” এর পরেই তিনি পড়শিদের বিষয়টি জানান।
যদিও এ সব অভিযোগ মানতে নারাজ প্রিয়াঙ্কা। তাঁর দাবি, এ সবই ষড়যন্ত্র। তাঁর ছেলে কয়েক দিন আগে পড়ে গিয়ে চোট পায়। সে নিজেই ব্লেড দিয়ে গা কেটেছে। কিন্তু কোনও শিশু কি এ ভাবে নিজের গা কাটতে পারে? কেনই বা জখম শিশুপুত্রের চিকিৎসা করাননি তিনি? কোনও উত্তর দিতে পারেননি প্রিয়াঙ্কা।
এ দিনের ঘটনার পরে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ পুলিশও। কারণ, বিদেশে এ ধরনের অভিযোগে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে। পরিবারের থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় শিশুদেরও।
এ ক্ষেত্রে কী করবে কলকাতা পুলিশ?
পুলিশ সূত্রের খবর, এ ধরনের অভিযোগ পেলে সাধারণত চটজলদি ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় থাকে না। তবে, বিষয়টি জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে সুপারিশ করা যেতে পারে। অথবা, শিশুটি বা তার বাবা যদি পুলিশে ওই মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তা হলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে। এ দিন সেই ধরনেরই ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। পুলিশ সূত্রের খবর, এ ক্ষেত্রে শিশুদের সরকারি বা বেসরকারি হোমে পাঠায় আদালত। পরিবারের কেউ শিশুটির দায়িত্ব নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানালে, পরিস্থিতি অনুযায়ী আদালত সিদ্ধান্ত নেয়। এ দিন ঋষিব্রতর মা-বাবা এবং অন্য পরিজনদের থানায় ডেকে পাঠায় পুলিশ।
কিন্তু আইনের বাইরে আরও একটি বিষয়ও রয়েছে। তা হল শিশুটির মানসিক অবস্থা। শিশু মনস্তত্ত্ববিদেরা বলছেন, যে ধরনের অত্যাচার শিশুটির উপরে হয়েছে, তা মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কারণ, কোনও শিশুর কাছে সব চেয়ে বড় ভরসা তার মা। মায়ের কাছ থেকে আঘাত পেলে শিশুর পক্ষে তা মেনে নেওয়া কঠিন। শিশু মনস্তত্ত্ববিদ হিরণ্ময় সাহা বলেন, “এখন ওই শিশুটির কাউন্সেলিং এবং মানসিক ভাবে তাকে সাহায্য করা উচিত। না হলে অচিরেই সে মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে।”
কী করে এক জন মা এ ভাবে নিজের সন্তানকে অত্যাচার করতে পারেন?
মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, “নিজের সন্তানকে এ ভাবে অত্যাচারের মানসিকতা অসুস্থতার পরিচয় দেয়। স্বামী পরিত্যক্তা হওয়ায় ওই মহিলার মধ্যে গভীর হতাশা কাজ করেছে। পাশাপাশি, নিজের ছেলেকে স্বামীর প্রতিভূ হিসেবে দেখেছেন তিনি। তাই হয়তো স্বামীর উপরে জমে থাকা রাগ ছেলের উপরে উগরে দিয়েছেন ওই মহিলা। |