ছুরি, প্রহারে জখম হয়ে যুঝলেন তিন দিন
ভাগ্নির সম্মান বাঁচাতে গিয়ে খুন পুলিশকর্মী
দোলের দিন রং মাখানোর অজুহাতে ভাগ্নির ‘শ্লীলতাহানি’ করা হচ্ছে দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি তিনি। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এক দল সশস্ত্র যুবকের বিরুদ্ধে। যার মূল্য প্রাণ দিয়ে চোকাতে হল কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল অসীম দামকে।
বৃহস্পতিবার ঘটনাটি ঘটেছে খাস কলকাতা লাগোয়া বিমানবন্দর থানা এলাকার বিশরপাড়ায়। ‘শ্লীলতাহানি’তে বাধা দেওয়ার ‘অপরাধে’ অসীমবাবুকে হকি স্টিক দিয়ে পিটিয়ে, ধারালো অস্ত্রে কুপিয়ে বাড়ির সামনে আধমরা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়। রবিবার হাসপাতালে মারা যান ৪৮ বছরের ওই পুলিশকর্মী।
অসীম দাম
২০০২-এর ৩১ ডিসেম্বর বর্ষবরণের রাতে পথচলতি এক অচেনা মহিলার শ্লীলতাহানি ঠেকাতে গিয়ে প্রহারে খুন হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের সার্জেন্ট বাপি সেন। তাতে দোষী পাঁচ পুলিশকর্মীর যাবজ্জীবন হয়েছে। আর বৃহস্পতিবার, দোল উৎসবের দিনে বাড়ির মেয়ের আব্রু বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন কনস্টেবল অসীমবাবু, যদিও এখনও পুলিশ অভিযুক্তদের এক জনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি। উঠেছে অভিযুক্তদের ‘আড়াল করার চেষ্টা’র অভিযোগও। কী রকম?
অসীমবাবুর পরিজনদের বক্তব্য: ঘটনার পরে তাঁরা সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন বাড়ির কাছে নিমতা থানায়, যেখান থেকে তাঁদের কার্যত ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়। নিমতা থানায় বলা হয়, ঘটনাস্থলটি তাদের আওতায় পড়ে না, অতএব তাদের দায়িত্ব নেই। তখন ওঁরা যান বিমানবন্দর থানায়। কিন্তু ওই থানাও এফআইআর নিতে চায়নি বলে অভিযোগ। অসীমবাবুর পরিবারের দাবি, পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার স্থানীয় এক ক্লাবের সদস্যদের ‘চাপে পড়ে’ অভিযোগ নথিভুক্ত করে বিমানবন্দর থানা।
বৃহস্পতিবার কী হয়েছিল অসীমবাবুর বাড়িতে?
মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর। রবিবার বিশরপাড়ায়। ছবি: সুদীপ ঘোষ
পরিজনেরা জানিয়েছেন, ফি বছরের মতো এ বারও দোলের দিন তাঁদের বিশরপাড়া নবজীবন কলোনির বাড়িতে কীর্তনের আসর বসেছিল। উঠোনের সামিয়ানার নীচে বাড়ির লোক ছাড়া কিছু বয়স্ক পড়শি, কীর্তনশিল্পী ও ভোগ রান্নার ঠাকুর মিলিয়ে জনা পঞ্চাশেক স্ত্রী-পুরুষ ছিলেন। দুপুরের দিকে জনা পনেরো ছেলে সামনের রাস্তা দিয়ে মদ খেতে খেতে যাওয়ার সময়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে বলে ওঁদের অভিযোগ। অসীমবাবুর দিদি সোমা ধরের কথায়, “ওরা হঠাৎ ঢুকে এসে সবাইকে রং মাখাতে শুরু করল! মেয়েদেরও! কারও বারণ শুনল না!”
বাড়ির লোক জানিয়েছেন, এই অভব্যতা আটকাতে গিয়েছিলেন অসীমবাবুর মা রেণুবালা দেবী। মদ্যপের দল আশি বছরের বৃদ্ধাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তার পরেই চড়াও হয় অসীমবাবুর এক ভাগ্নির উপরে। অভিযোগ, জবরদস্তি রং মাখানোর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির শ্লীলতাহানি করতে থাকে তারা। তখনই দু’ভাই সোমনাথ-শেখরকে নিয়ে রুখে দাঁড়ান অসীমবাবু। দুষ্কৃতীরা তাদের মারধর করে। শেখরের মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। বাড়ি, উঠোন লন্ডভন্ড করে ছেলেগুলো তখনকার মতো বিদায় নেয়।
কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই মেটেনি।
অসীমবাবুর আত্মীয়েরা জানিয়েছেন, আধ ঘণ্টা পরে ছেলেগুলো আরও দলবল জুটিয়ে ফিরে আসে। কুড়ি-পঁচিশটা ছেলের অনেকের হাতে ছিল ছুরি, লোহার রড, হকি স্টিক, উইকেট, এমনকী পিস্তলও। শেখরবাবুর কথায়, “সামনে যাকে পাচ্ছিল, তাঁকেই মারছিল। মায়ের হাতে ছুরির কোপ লাগে। দিদিরা মার খায়। কয়েক জনকে মাটিতে ফেলে পেটানো হয়। ফের ওই ভাগ্নিকে ধরে ওরা টানাটানি করতে থাকে। তাই দেখে দাদা আর স্থির থাকতে পারেনি।”
পরিজনেরা জানিয়েছেন, ভাগ্নির সম্ভ্রম রক্ষা করতে অসীমবাবু ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ছেলেগুলোর উপরে। যার ফলে দুর্বৃত্তদের সম্মিলিত রোষ তাঁর উপরে আছড়ে পড়ে। রবিবার সোমাদেবী বলেন, “তিন-চারটে ছেলে ভাইকে জাপটে ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল। এক জন হকি স্টিক দিয়ে মাথায় মারল প্রচণ্ড জোরে। একটা আওয়াজ শুনলাম। পর ক্ষণে দেখলাম, ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। মাথা থেকে রক্ত, ঘিলু বেরিয়ে আসছে।” বাড়ির লোক জানিয়েছেন, অসীমবাবু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। দুষ্কৃতীরা তখনও তাকে ধারালো অস্ত্রে কোপাতে থাকে। “কোপাচ্ছিল আর বলছিল, পুলিশকে আমরা এ ভাবেই কোপাই। দুনিয়ার কোনও জেলের ক্ষমতা নেই আমাদের আটকে রাখে।” জানান সোমাদেবী।
নিহত কনস্টেবল অসীম দামের মা রেণুবালা দাম। (ডান দিকে) এনআরএস হাসপাতালের
মর্গের সামনে ভাই শেখর দাম। ছবি: সুদীপ ঘোষ ও সুদীপ আচার্য
গণ্ডগোলের খবর ছড়াতে পাড়ার লোকজন চলে আসেন। আহতদের চিকিৎসার উদ্যোগ শুরু হয়। কিন্তু দুষ্কৃতীরা তাতেও বাধা দেয় বলে পড়শিদের অভিযোগ। স্থানীয় এক যুবক বলেন, “ওই বাড়ির ১৮-২০ জনের আঘাত লেগেছিল। দোলের দুপুরে রাস্তায় গাড়ি মিলছিল না। কোনও মতে অসীমদাকে রিকশায়
চাপিয়ে এক কিলোমিটার দূরে নর্থ দমদম মিউনিসিপ্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দেখি, গুণ্ডারা ওখানেও পৌঁছে গিয়েছে!” এক জন বলেন, “ওরা পিস্তল, ছুরি বার করে ডাক্তারবাবুদের শাসাচ্ছিল। মহিলারা তখন ভয়ে কাঁপছেন। অসীমদার মাথা থেকে প্রচণ্ড রক্ত বেরোচ্ছে। তবু অন্তত ঘণ্টা দেড়েক ওঁর কোনও চিকিৎসাই করা গেল না!”
পরে অসীমবাবুকে আরজিকরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বাইপাসের এক হাসপাতালে। তা-ও শেষরক্ষা হয়নি। পীযূষ শিকদার, সঞ্জীব দে’র মতো স্থানীয় ছেলেদের আক্ষেপ, ‘‘আর একটু আগে যদি চিকিৎসা শুরু করা যেত, হয়ত প্রাণে বাঁচত অসীমদা!”
আঙুল কাদের দিকে?
বৃহস্পতিবারের হামলায় বাবু চক্রবর্তী, তপন চন্দ্র, জবর ঘোষ, অভিজিৎ ঘোষ, বিশ্বজিৎ ঘোষ, পঙ্কা দত্ত, বাডু মজুমদার, দেবু মুখোপাধ্যায় জড়িত বলে জানিয়েছেন অসীমবাবুর আত্মীয়-বন্ধুরা অভিযোগ। ওই যুবকদের নামে থানায় অভিযোগও দায়ের করেছেন তাঁরা। এলাকাবাসীর এ-ও অভিযোগ, ছেলেগুলি বিলকান্দা-লেনিনগড়ে তৈরি চোলাই বিশরপাড়া স্টেশন দিয়ে অন্যত্র পাচার করে, তাই রেল-পুলিশ ও নিমতা থানার কিছু পুলিশকর্মীর সঙ্গে তাদের যথেষ্ট ‘মাখামাখি।’ বাসিন্দাদের অনেকে বলছেন, সন্ধের পরে কিছু পুলিশকর্মী নিয়মিত ওদের সঙ্গে মদের আসরে বসেন। এমনকী, সপ্তগ্রাম এলাকার ওই দুষ্কৃতীদের সঙ্গে স্থানীয় সিপিএম নেতাদের একাংশের ‘সুসম্পর্কের’ কথাও শোনা গিয়েছে কিছু বাসিন্দার মুখে। উল্লেখ্য, অভিযুক্ত বাবু হল বিশরপাড়ার সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর ছেলে। তপন চন্দ্র ডিওয়াইএফআই নেতা।
এবং এই পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীর একাংশের নালিশ, ‘পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা’ ও ‘রাজনৈতিক যোগাযোগের’ সুবাদেই অভিযুক্তদের কাউকে ধরা হয়নি। নবজীবন কলোনির এক বাসিন্দার কথায়, “পুলিশ আর নেতাদের সঙ্গে ওদের ওঠা-বসা! আমরা আর কী করব?” সিপিএম নেতারা কী বলছেন?
উত্তর ২৪ পরগনার সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ অমিতাভ নন্দীর বক্তব্য, “আমাদের দলের কেউ এতে যুক্ত নয়। নারকীয় ও দুঃখজনক ঘটনা। পুলিশ প্রথমে অভিযোগ নিতেই চায়নি! পরে অভিযোগ নিলেও এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি! রাজ্যের পরিস্থিতি এবং পুলিশ-প্রশাসন কতটা দুর্বল, এটা তা-ই প্রমাণ করছে।” এ দিন দুবরাজপুরে সিটু-র রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীও বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের নিরাপত্তা বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে। পুলিশকেও এ বার বুঝতে হবে, কোন শক্তি রাজ্যে সরকার পরিচালনা করছে!”
পুলিশ-কর্তারা কী বলছেন?
সংশয়ের জাল
• প্রশ্ন: ৮ মার্চ দুই থানা অভিযোগ নিল না কেন?
নিমতা থানা: ঘটনাটি আমাদের এলাকার নয়।
বিমানবন্দর থানা: ঘটনার গুরুত্ব বোঝা যায়নি।
• প্রশ্ন: অভিযোগের গুরুত্ব বোঝা গেল না কেন?
পুলিশ: প্রথমে মনে হয়েছিল, জমি সংক্রান্ত বিরোধ।
• প্রশ্ন: অভিযোগ লিপিবদ্ধ করাতে ক্লাবের সাহায্য লাগল কেন?
পুলিশ: নিহতের বাড়ির লোকের থেকেই অভিযোগ নিয়েছি।
• প্রশ্ন: কেউ ধরা পড়েনি কেন?
পুলিশ: অভিযুক্তেরা এলাকায় নেই।
• প্রশ্ন: অসীম দাম মারা না-গেলে কি তদন্ত ধামাচাপা পড়ত?
পুলিশ: অভিযোগ লিপিবদ্ধ হতেই তদন্ত শুরু হয়েছে।
বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের তরফে অবশ্য অভিযোগ না-নেওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (বিমানবন্দর) তরুণ হালদারের দাবি: অভিযোগ গ্রহণ করে ঠিক সময়েই তদন্ত শুরু হয়েছে। জবরদস্তি রং মাখানোর চেষ্টা কিংবা ইভটিজিংয়ের কোনও নালিশ ৯ মার্চ (দোলের পর দিন) দায়ের করা হয়নি বলেও তাঁর দাবি। কিন্তু অসীমবাবুকে গুরুতর ভাবে মারধর করার পরেও কেন অভিযুক্তদের গ্রেফতার করল না পুলিশ? তরুণবাবুর জবাব, “এ ক্ষেত্রে থানার কোনও গাফিলতি থাকলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। ওঁর বাড়ির লোক এ বার ইভটিজিংয়ের অভিযোগ দায়ের করলে তা নিয়েও তদন্ত হবে। অভিযুক্তদের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় হানা দেওয়া হচ্ছে। তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে।”
এ দিন দুপুরে এনআরএসের পুলিশ-মর্গে অসীমবাবুর মৃতদেহের ময়না-তদন্ত হয়। গত তিন মাস তিনি শিয়ালদহের ‘স্মল কজেস’ আদালতে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানাতে হাসপাতালে আসেন ওই আদালতের বিচারক বিপ্লব রায়। বিপ্লববাবু বলেন, “অসীম নিজের কাজে যত্নবান ছিলেন।” পারিবারিক সূত্রে খবর, অবিবাহিত অসীমবাবুর কাঁধেই ছিল যৌথ সংসার প্রতিপালনের ভার। ভাই শেখর বলেন, “আমাদের দেখবেন বলে দাদা বিয়ে পর্যন্ত করেননি। এ বার আমরা কোথায় যাব?” ময়না-তদন্তের পরে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে অসীমবাবুর দেহ এন্টালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
নিহত পুলিশকর্মীর দেহ বিকেলে নিয়ে যাওয়া হয় বিশরপাড়ায়। এলাকার কয়েক হাজার লোক সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.