হাতে বলটা ধরে আনমনে অনেকক্ষণ সে দিকেই তাকিয়ে ছিলেন ভারত অধিনায়ক। একা। চারপাশে কেউ নেই।
ফুটবল কখনও সুখের পৃথিবী। কখনও অনন্ত দুঃখের আয়না।
বলটার দিকে তাকিয়ে কী ভাবছিলেন বিষণ্ণ সুনীল ছেত্রী?
ভারতের প্র্যাক্টিস শেষ হয়ে আসছে। সুনীল স্ট্রেচিং সেরে এসে মাটিতে বসে। নেপালি কিশোর ফুটবলারদের দঙ্গল তাঁর সঙ্গে গ্রুপ ছবি তুলতে এল। তখনও হাসি নেই। রাতে টিম হোটেলের লবিতে অবশ্য সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় হাসিটা সামান্য ফিরল অধিনায়কের। “হঠাৎই সিনিয়র হয়ে গেছি। এক বছর আগেই জুনিয়র বলা হত আমায়। টিম বাসে সবার পিছনের সিটে বসতাম।”
সহ-অধিনায়কের মুখেও চিরকালের ‘লড়কে লেঙ্গে’ ব্যাপারটা অদৃশ্য। সৈয়দ রহিম নবির মুখের চিরকালীন হাসি উধাও। “কাজটা খুব কঠিন। এত দিন ভারতের হয়ে খেলছি, এত খারাপ খেলতে দেখিনি”, বলার পরে নবি মেনে নিলেন, “সিনিয়রদের অভাব অনুভব করছি। মিলেমিশে টিমটা করলে ভাল হত।” সুনীল অতটা স্পষ্ট না হলেও স্মৃতিকাতর সিনিয়রদের নাম উঠলে।
ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে ললিতপুরে নেপাল ফুটবল সংস্থার ওই নিজস্ব মাঠ গমগম করছিল শেপ ব্লাটারের উপস্থিতিতে। কত ফুটবলার সেখানে। ফিফা প্রেসিডেন্ট, এ এফ সি প্রেসিডেন্টের জন্য বরাদ্দ পুষ্পস্তবকগুলো আজ গ্যালারিতে অবহেলায় পড়ে। সেলোফেনে মোড়া ফুলগুলো শুকিয়ে গিয়েছে। প্র্যাক্টিসে নামার আগে, মাঠে চক্কর কাটার সময় স্যাভিও মিদেইরা কিছু সময় সুনীলের ঘাড়ে হাত দিয়ে আলোচনা করলেন। কিছুক্ষণ নবির সঙ্গে। ফুল একবার শুকিয়ে গেলে কি ঔজ্জ্বল্য আসে আবার?
ঠান্ডা পাহাড়ি কাঠমান্ডুতে, খেলার আগে ভারতীয়রা শিবির করে এসেছিল সমুদ্রপারের উষ্ণ দুবাইয়ে। দুবাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫২ ফুট উঁচুতে,আর কাঠমান্ডু ৪৬০০ ফুট। এই বোকাবোকা অবৈজ্ঞানিক ব্যাপারটা কারও মাথায় আসেনি। তাজিকদের কাছে অবাক হারের পরে সব বেরোচ্ছে। নবি, সমীর নায়েকরা বিরতির পরে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছিলেন। বিরতির পরে ঝিমিয়ে পড়ার যা একটা কারণ। রাজু গায়কোয়াড়রা আবার প্রথমার্ধে সমস্যায় পড়ছিলেন দম নিতে। আপনারা কাঠমান্ডুতে শিবির করলেন না কেন? স্যাভিওর ঠোঁটেই জবাব, “এখানে পরিকাঠামো ভাল নয়। দেখছেন তো, মাঠও ভাল নেই।” ভবি আসলে ভোলার নয়।
রবিবার যাঁদের সঙ্গে হারলেই বিদায়, সেই ফিলিপাইন্স এ বার এ এফ সি চ্যালেঞ্জ কাপের সেরা বিতর্ক ও বিস্ময়। ২-০ জিতে কোরিয়ান কোচ য়ুং জং সু বিশাল সার্টিফিকেট দিয়েছেন, “ওরা এত উন্নতি করেছে, ভাবতে পারিনি। ভারত, তাজিকিস্তানকে ওরা হারিয়ে দিতে পারে।” ম্যানিলার কাগজগুলো ইন্টারনেটে পড়লে বোঝা যায়, হেরেও দলটা টগবগে। ফুলগুলো ওখানে পুরো শুকোয়নি। বরং যৌন কেলেঙ্কারির বিতর্কে ডুবে ঢাকা দলটা ভাল খেলে জেগে উঠেছে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের এত দিনেও জোগাড় করে উঠতে পারেনি এ আই এফ এফ। ফিলিপিনোদের জাতীয় দলের ধারণাই কিন্তু পাল্টে দিয়েছেন ফিলিপিনো বংশোদ্ভূত বিদেশিরা। কোরিয়ানরা যাঁর জন্য গোল বাড়াতে পারেননি, পেনাল্টি বাঁচানো সেই কিপার নীল এথেরিজ ফুলহ্যামের তিন নম্বর কিপার। ক’দিন আগে ইউরোপা লিগে খেললেন। এই দলটায় ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, আইসল্যান্ডের ক্লাবে খেলা ফুটবলার রয়েছেন, যাঁদের তিন জনকে প্রথম দলে রাখেননি জার্মান কোচ মাইকেল ওয়েস। সম্প্রতি ফিলিপাইন্স জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন আরও বারো জন ইউরোপ, আমেরিকার ক্লাব ফুটবলার। জানি না, এশিয়ায় আর কোথাও এই উদাহরণ আছে কি না।
সুনীল ছেত্রীদের কাল মাথাব্যথার বড় কারণ চেলসি অ্যাকাডেমির তিন ফুটবলার। গোলকিপার এথেরিজ ও দুই ভাই জেমস ইয়ংহাসব্যান্ড, ফিল ইয়ংহাসব্যান্ড। তিন জনেরই বাবা ইংরেজ, মা ফিলিপিনো। খেলা শুরু করেছিলেন চেলসি অ্যাকাডেমিতে। দুই ভাই ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলে এ বার নাম লিখিয়েছেন ফিলিপাইন্সের ক্লাবে। ২২ বছরের এথেরিজকে চার্লটনে লোনে দিয়েও ছয় দিনে ফেরত নিয়েছে ফুলহ্যাম।
কাঠমান্ডুতে ফিলিপিনোদের সবটাই আলো নয়, আঁধারও আছে। মাথায় ঝুলছে বিশাল বিতর্কের খড়্গ। ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব ১৬র জাতীয় দলে খেলা এথেরিজ গত বছর জুলাইয়ে এক ধর্ষণ মামলায় জড়িয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল, জাতীয় দলের তিন সতীর্থর সঙ্গে এক ফিলিপিনোকে ধর্ষণ করেছেন। এত দিনে তিনি নির্দোষ প্রমাণ হলেও তাঁর দুই সতীর্থ আরও বড় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
আর এক যৌন কেলেঙ্কারি। দশ দিন আগে ফিলিপাইন্স বনাম মালয়েশিয়া ম্যাচের সময় ফিফার মহিলা ম্যাচ কমিশনার ক্রিস্টি র্যামোস তাঁদের ড্রেসিংরুম পরীক্ষা করতে গেছিলেন। সেখানে চিনা বংশোদ্ভূত ফিলিপিনো ফুটবলার লেক্সটন মো জঘন্য ইঙ্গিত করেন র্যামোসকে। আর এক ফুটবলার অ্যাঞ্জেল গুয়াইর্দো প্রায় নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন তাঁর সামনে।
ক্রিস্টি র্যামোস আবার প্রাক্তন ফিলিপাইন্স প্রেসিডেন্ট ফিদেল র্যামোসের মেয়ে। ফিলিপাইন্স অলিম্পিক সংস্থার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। তিনি ছাড়বেন কেন? সরাসরি অভিযোগ ফিফায়। তাঁর যৌন নিগ্রহের অভিযোগে তদন্তে নেমেছে এ এফ সি। দোষী প্রমাণিত হলেই শাস্তি। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট র্যামোস ও তাঁর স্ত্রী কড়া সমালোচনা করেছেন জাতীয় ফুটবলারদের। অধিনায়ক জেমস ইয়ংহাসব্যান্ডের উদ্দেশে কড়া বার্তা পাঠিয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ক। মেয়েকে নিয়ে দলের সবাই হাসাহাসি করায় ঘটনাটা নিয়ে ও দেশে তুমুল হইচই চলছে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে দুই ফুটবলারই খেলেছেন জাতীয় দলে।
এত বিতর্কে আচ্ছন্ন প্রতিপক্ষর বিরুদ্ধে সুবিধে নিতে পারবে ভারত? দল নিয়েই তো স্যাভিও দ্বিধায়। সকালে মনে হচ্ছিল, মাঝমাঠে জুয়েল বা ভাসুম, ফরোয়ার্ডে জোয়াকিম আব্রামচেস ঢুকতে পারেন। রাতে শোনা গেল, একই দল রাখার কথা ভাবছেন। মানে, দ্বিধাই কাটেনি। ফেডারেশনের ডাচ টিডি রব বান দেখলাম, সারাক্ষণ দেখে যাচ্ছেন প্র্যাক্টিস। গ্যালারিতে পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়। রব বান স্যার, আপনার বোধহয় এ বার জাতীয় দলে হস্তক্ষেপ করার সময় এসেছে! |