অবসরের চব্বিশ ঘণ্টা পরেও রাহুলকে ঘিরে গভীর নিম্নচাপ

সচিন ক্রিকেটের ভগবান।
সৌরভ অফসাইডের সর্বজনস্বীকৃত ঈশ্বর।
লক্ষ্মণ টেস্টে চতুর্থ ইনিংসের ভগবান।
কিন্তু দিনের শেষে যখন মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, খোদ ভগবানকেও থাকতে হয় দেওয়ালের পিছনে, ‘বিহাইন্ড দ্য ওয়াল!’


অবসর ঘোষণার চব্বিশ ঘন্টা পরেও এ ভাবেই রাহুল ‘ওয়াল’ দ্রাবিড়ের বন্দনায় ভেসে যাচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস। শোকের মেঘ হাল্কা হওয়া তো দূরস্থান, বরং আরও গভীরতর নিম্নচাপ হয়ে জেঁকে বসছে ক্রিকেটমহলে। শুরুতে যেটা পড়লেন, সেটা গত শুক্রবার রাত থেকে ফেসবুকে হু হু ছড়িয়ে যাচ্ছে, এসএমএসের হাত ধরে পৌঁছে যাচ্ছে মোবাইল থেকে মোবাইলে। কলকাতা থেকে কোয়েম্বাটুর, ভূপাল থেকে ভেলোর, রাহুল শরদ দ্রাবিড়কে ঘিরে শ্রদ্ধা, শোক এবং শূন্যতার আবর্তে এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। ক্রিকেটজনতার আবেগের প্লাবন যে ভাবে এখনও অব্যাহত, মনে হচ্ছে কেরিয়ারের সেরা সময়েও পার্শ্বনায়কের চেয়ে বেশি মর্যাদা না দেওয়ার ‘পাপ’-এর প্রায়শ্চিত্ত পর্ব চলছে যেন।
এবং সবচেয়ে যেটা তাৎপর্যের, এই আবেগের স্রোতে কোনও জেনারেশন গ্যাপ নেই। ধুয়ে মুছে সাফ প্রজন্মের ব্যবধান। কিছু হাতে গোণা সার্বজনীন ব্যতিক্রম বাদ দিলে ‘নায়ক’ তো সচরাচর পাল্টেই যায় প্রজন্মের সেতু ধরে। সে রাজনীতিই হোক বা সিনেমা, গানবাজনাই হোক বা খেলা। সানির ব্যাটিং দেখে যাঁদের বড় হওয়া, সচিন দেড়শো সেঞ্চুরি করলেও তাঁদের কাছে গাওস্করই সব সময় আগে। সচিন যুগে যাঁদের বেড়ে ওঠা, যাঁরা সানিকে দেখেছেন শুধু পুরনো টিভি ফুটেজে, তাঁদের গাওস্করের প্রতি সমীহ আছে, কিন্তু নায়কের আসনে অবধারিত তেন্ডুলকর। চুনী-পিকে-বলরামে মজে থাকা মধ্য ষাট বা মধ্য সত্তরের বাঙালির কাছে সেই ওঁরাই চিরকালীন ফুটবল হিরো। তা ভাইচুং বা বিজয়নের যত কীর্তিই থাকুক না কেন। উল্টোটাও তো সত্যি। বাবা-জ্যাঠাদের কাছে পাঁচ বা ছয়ের দশকের রথী-মহারথীদের গল্প শোনা প্রজন্ম চুনী-পিকেদের জন্য সম্ভ্রম ঠিকই বরাদ্দ করে, কিন্তু চোখের সামনে নিত্য দিন দেখা ভাইচুং বা সুনীল ছেত্রী নায়ক থেকে যান। রাহুল দ্রাবিড়ের অবসরে প্রতিক্রিয়ার যে অভিঘাত তৈরি হয়েছে, সেটা অবশ্য তাঁর ব্যাটিংয়ের মতোই দুর্ভেদ্য। যাতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে প্রজন্মগত পছন্দ-অপছন্দ। ষাট ছুঁইছুই জয় গোস্বামী থেকে তিরিশের পরমব্রত, সত্তরোর্ধ্ব সুনীল থেকে চারুলতা ২০১১-এর ঋতুপর্ণা, ২৮ বছর পরে অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়া বাঙালি শু্যটার জয়দীপ কর্মকার কিংবা আইপ্যাড, ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জার, আই ফোনে বুঁদ উনিশ-কুড়ির দঙ্গল, সব্বাই আপ্লুত রাহুলে। সানি বলতে যাঁরা অজ্ঞান তাঁরাও, সচিন যাঁদের ‘ভগবান’, তাঁরাও। টি-টোয়েন্টির ধুমধাড়াক্কা ছাড়া ক্রিকেটে যাঁদের রুচি নেই, কী আশ্চর্য, তাঁরাও! যখন খেলতেন, তখন যেটা কখনওই মালুম হয়নি, অবসরের পরে সেটা বারে বারে প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে গত চব্বিশ ঘণ্টায়। রাহুল দ্রাবিড় সেই বিরল বলয়ে পৌঁছে গিয়েছেন, যেখানে ‘নায়ক’-এর অধিষ্ঠান স্থান-কাল-পাত্র বা সময়-বয়স-প্রজন্মের তোয়াক্কা করে না।
সাহিত্যের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলছেন, “আমি রাহুলের ক্রিকেটের ভক্ত। ওর মধ্যে ধৈর্য, শৃঙ্খলা আর সংযমের এমন একটা মিশেল রয়েছে, যা সাধারণত দেখা যায় না। আর একজন দ্রাবিড় খুঁজে পাওয়া কিন্তু কঠিন হবে বলেই মনে হয়।” আবার সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে লেখা হচ্ছে, দ্রাবিড় টেস্ট ক্রিকেট ছাড়তে পারেন, কিন্তু এই সঙ্কটের সময় দ্রাবিড়কে হারাতে পারে না টেস্ট ক্রিকেট। বরাবরের গাওস্কর ভক্ত কবি জয় গোস্বামীও আক্রান্ত দ্রাবিড় দর্শনে। “হবস, হটন, কাউড্র্রে, ব্যারিংটন, হানিফ, বিজয় হাজারে। গাওস্করের পর দ্রাবিড়। মাঝে আর কেউ নেই। ক্রিকেটের একটা বিশেষ মনোভঙ্গি বা দৃষ্টিভঙ্গি রাহুল চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট থেকে চিরকালের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেল। এই মনোভঙ্গি কোনও দিন সহবাগ বা ধোনির কাছে পাওয়া যাবে না। সেই মনোভঙ্গি যা সময় মতো ব্যাট সরিয়ে নিতে জানে, সময় মতো থামতে জানে। ক্রিকেটে তো মারাটাই সব নয়, সময় মতো ব্যাট সরিয়ে নিতে পারাটাও তো ব্যাটিং,” ব্যাখ্যা জয়ের।
“ছেড়ে দিয়েছেন সময়ে। আর এ জন্যই রাহুল দ্রাবিড়,” বলছেন শ্যুটার জয়দীপ। আর অভিনেত্রী ঋতুপর্ণার সহজ স্বীকারোক্তি, “ভীষণ ডিপেন্ড করা যেত ওর উপর। সেটা ভীষণ মিস করব।” আবার পরমব্রত বলছেন, “রাহুল যখন টেস্ট খেলতে শুরু করে, আমি ক্লাস এইটে পড়তাম। রাহুল মানেই আমার কাছে শিক্ষা, রুচিবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, দায়িত্বশীলতা। আর একটা রাহুল? নাহ, অদূর ভবিষ্যতে হবে বলে মনে হয় না।”
রাহুলের দর্শন বলে ব্যক্তির আগে টিম, সৌন্দর্যের আগে সংকল্প, হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে চ্যালেঞ্জ, ঔদ্ধত্যের আগে বিনয়। ‘চাপ’ শব্দটা ক্লিশে, ওটা খেলতে নামার আগে প্রত্যেক ক্রীড়াবিদেরই থাকে। আসল কথা হল, হয় তুমি পারবে বা পারবে না। আর রাহুলের জীবনদর্শনে অবধারিত আসবে নোবেলজয়ী ফরাসি ঔপন্যাসিক অ্যালবেয়ার কামুর অমর উক্তি, “ইফ দেয়ার ইজ নো হোপ, ইউ ক্যান ইনভেন্ট হোপ।” কোনও আশা না থাকলে আশাকে আবিষ্কার করতে হয় আর সেটাই সারা জীবন ধরে করে গিয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়।
অবসর পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় যা ইঙ্গিত, যত দিন যাবে রাহুল মাহাত্ম্য পরতে পরতে আরও উন্মোচিত হবে, গবেষণার পর্যাপ্ত রসদ নিয়ে হাজির হবে তাঁর ষোলো বছরের ক্রিকেট সফর। বই তো নিশ্চয়ই আরও লেখা হবে, অদূর ভবিষ্যতে রাহুলকে নিয়ে তৈরি হবে তথ্যচিত্র। আর যখন সেটা হবে, তখন অন্তত নামটা নিয়ে পরিচালককে খুব বেশি ভাবতে হবে না। ১৯৮২-তে মুক্তি পাওয়া বহু পুরস্কার প্রাপ্ত সেই মার্কিন ছবিটার নাম একটু পাল্টে দিলেই হবে। সেই যে, মার্কিন নৌবাহিনীর এক অফিসারকে নিয়ে তৈরি রিচার্ড গ্যের অভিনীত। ‘অ্যান অফিসার অ্যান্ড আ জেন্টলম্যান’
দ্বিতীয় শব্দটা শুধু পাল্টে গিয়ে দাঁড়াবে, ‘‘আ ক্রিকেটার অ্যান্ড আ জেন্টলম্যান!”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.