রাহুল দ্রাবিড় তাঁর অবসর ঘোষণার চব্বিশ ঘণ্টা পর ঢাকায় ডিওডোর্যান্ট খুঁজতে বেরোলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি...
আর ভারত অধিনায়ককে পাঁচতারা টিম হোটেলের দোকানে ঘুরে বেড়াতে দেখে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, আজ ডায়েরি লিখলে কী লিখতেন তিনি? এটাই যে, দুনিয়া মহান যোদ্ধার পতনে বিলাপ করতে পারে। শোকস্তব্ধ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আমার যে নতুন গন্ধ চাই। নতুন রং চাই। টিমে নতুন রক্ত চাই। আমার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। সহযোদ্ধার পতনে আমি ব্যথিত হব। বিদায়বেলায় তাঁকে যোগ্য সম্মান দেব। স্যালুট করব। কিন্তু একই সঙ্গে সংস্কারের যে পথে আমি বিশ্বাসী সেটাও আঁকড়ে ধরে থাকব।
একটু আগে সাংবাদিক সম্মেলন করে ফিরেছেন। সেটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়া সফরের বিতর্ক তাঁর ওপরেও সাংঘাতিক আঁচ ফেলেছে। এখন তিনি ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকতে চান। বীরেন্দ্র সহবাগের অভাব বোধ করবেন? ধোনির জবাব, “অবশ্যই করব। শুরুর দিকে ও যে ভাবে টেম্পোটা ঠিক করে দিয়ে যায়, অনেক ম্যাচের ফয়সালা তো ওখানেই হয়ে যেতে দেখেছি।”
রবিবার থেকে মীরপুরের মাঠে শুরু হচ্ছে এশিয়া কাপ। উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ। ধোনির ভারত গত বারের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মঙ্গলবার নামছে মাহেলা জয়বর্ধনের শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। সেই শ্রীলঙ্কা যারা কিনা তাঁদের ছিটকে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায় ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল থেকে। সন্ধ্যার দিকে আবার আচমকা রটে যায় যে, সচিন তেন্ডুলকর নাকি শততম সেঞ্চুরি করেই অবসর নেবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার প্রচার করা হতে থাকে, সচিন নিজে এই খবর অস্বীকার করেছেন।
রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে অবধারিত ভাবেই প্রশ্ন হওয়ার ছিল। ধোনি বললেন, “ড্রেসিংরুমে পাওয়ার জন্য রাহুল একটা অসাধারণ চরিত্র ছিল। ওর দিকে যখন যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে, ও সেটা গ্রহণ করেছে। উইকেটকিপিং থেকে ওপেনিং কোনও কিছুতেই ‘না’ বলেনি।” ইনি অস্ট্রেলীয় সফর-উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনের ধোনি। যিনি বোর্ড প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসনের ফোন, নানা ময়নাতদন্ত আর মন্তব্যের জেরে সাময়িক নিজেকে বিতর্কহীন রাখবেন বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনের বাইরের ধোনি নিছক অধিনায়ক ধোনি নন। সংস্কার করতে চাওয়া ধোনি। |
এই ধোনি ঘনিষ্ঠমহলে ব্যাখ্যা দেবেন এ রকম:
...রাহুল ইচ্ছে করলে এখনও অনেক দিন খেলে যেতে পারত। অন্তত এক বছর। রাহুলের যা ক্লাস তাতে রানও করে দিত। কিন্তু এখন যা টেস্ট আছে সবই দেশের মাটিতে। এই সময় যদি তরুণ কাউকে সুযোগ না দেওয়া হয় তা হলে সে বিদেশের ঝড়-ঝঞ্ঝার জন্য তৈরি হবে কী করে? আজ থেকে বারো মাস পরে তাকে দুম করে বিদেশের আগুনে পিচে নামিয়ে দিলে সে কী করবে! আমার মনে হয় রাহুল নিজেও এটা নিয়ে ভেবেছে আর ভেবেছে বলেই নিজে সরে গিয়ে এক তরুণকে সুযোগ করে দিতে চেয়েছে...
আবেগ আছে। কিন্তু আবেগের স্রোতে ভেসে যাওয়া নেই। শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু কোথাও শ্রদ্ধার অতিরঞ্জনে বর্তমানে পড়ে থাকা নেই। ক্রিকেট দুনিয়ার দুই মহাতারকার বিদায়বেলার তুলনা চলে আসছে। এক জন স্বেচ্ছায় চলে গেলেন। রাহুল দ্রাবিড়। অন্য জনকে ছেঁটে ফেলা হল। রিকি পন্টিং। গত দেড় দশকের ক্রিকেট ইতিহাসে যাঁরা থাকবেন খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জুড়ে। পন্টিংকে সরিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান-নির্বাচক জন ইনভেরারিটি বললেন, “তোমার অবদানকে আমরা সম্মান করি। এটাও আমরা মানি যে, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটকে তুমি যে ভাবে ঐতিহ্যশালী করেছ, হালফিলে কেউ করতে পারেনি। সন্দেহ নেই তোমার অভাব আমরা অনুভব করব। দেশকে দু’টো বিশ্বকাপ দিয়েছ তুমি। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের এখন সামনের দিকে তাকানোরও সময়।”
আজকের ধোনিকে দেখে যতটা না কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের দেশের দেখাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে ইনভেরারিটির দেশের। এক-আধ বার যাঁকে দেখে বেশ বিরক্ত মনে হচ্ছে, “ভারতীয় ক্রিকেটে ধারাবাহিকতার অভাব তো অনেক কাল ধরেই আছে। শারজায় যখন খেলা হত কোনও দিন ৪৫ অলআউট হয়ে যাচ্ছে, আবার তার পর দিন জিতছে। আমাদের আমলে এটা নতুন হল কোথায়?”
ডিওডোর্যান্ট বাছতে থাকার মধ্যেই ভারত অধিনায়ককে এক বার জিজ্ঞেস করতেই হল, কিন্তু আপনি কি মনে করেন যথেষ্ট উন্নত তরুণ রক্ত এ দেশে তৈরি আছে? জাতীয় নির্বাচকেরা তো প্রতিভাই খুঁজে পাচ্ছেন না! ধোনি: আছে কি নেই সেটা দেখার জন্য তাঁকে ন্যূনতম কতগুলো ম্যাচ দিতে হবে। দেখুন, যখন টিম জিতছে তখন ব্যর্থ হলেও আপনি তাকে সাতটা ম্যাচ দিতে পারেন। কিন্তু যখন টিম হারছে তখন তিনটে ম্যাচ দিলেই চিৎকার শুরু হয়ে যাবে। ভারতীয় ক্রিকেটে বিশ্লেষণগুলো বড্ড নেতিবাচক। ওই দ্যাখো, ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও ওকে তিনটে ম্যাচ দেওয়া হল। কোথাও আমাদের একটু ইতিবাচকও হতে হবে।
এই জায়গাটায় যদিও মনে হবে অধিনায়ক পুরোপুরি ঠিক বলছেন না। সুরেশ রায়নারা একাধিক সুযোগ পেয়ে চলেছেন। মনোজ তিওয়ারি সেঞ্চুরি করেও বাইরে বসে রয়েছেন।
প্রকাশ্য মন্তব্য বা সম্ভাব্য বিতর্কের কথা ভুলে গিয়ে লিফ্টের দিকে এগিয়ে যাওয়া ভারত অধিনায়ককে সরাসরি জিজ্ঞেস করতেই হল ভি ভি এস লক্ষ্মণের থেকে কী আশা করছেন? ধোনি কোনও জবাব দিলেন না। শুধু কাঁধ ঝাঁকিয়ে লিফ্টে উঠে গেলেন।
হোটেলের ঘরে ফিরে গিয়ে হয়তো ডায়েরির পাতায় লিখবেন: ভারতীয় ক্রিকেটে তোমাকে লক্ষ্মণরেখা বলা হত। তুমিই ভেবে দ্যাখো না কী করা উচিত! |