প্রবন্ধ...
পাথর-প্রতিমা
খনউয়ের মসনদ থেকে মায়াবতী নির্বাসিত হয়েছেন। এই নির্বাসন ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া থেকেই দলিতের নির্বাসন কি না, ভাবী কালই তার জবাব দেবে। কলিযুগে আর্যাবর্তের হৃদয়পুরে ‘চামার-কি-বেটি’র মুখ্যমন্ত্রিত্ব হাসিলের মধ্যে যে স্পর্ধা ছিল, ত্রেতায় বেদপাঠে নিরত শম্বুকের স্পর্ধা কিংবা দ্বাপরে ব্রাহ্মণ গুরুর কাছে নিষাদ একলব্যের অস্ত্রশিক্ষা করতে চাওয়ার স্পর্ধা থেকে তা কোনও কম অংশে কম উত্তুঙ্গ ছিল না। নিয়তির পরিহাস হল, এই নন্দিত স্পর্ধায় খড়্গাঘাত নেমে এল উচ্চবর্ণের কাছ থেকে তত নয়, যতটা অনগ্রসর ও সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে, দলিতের ক্ষমতায়নে যাদের শরিক না হলেও অন্তত শ্রেণিগত ভাবে সহযোগী হওয়ার কথা।
২০০৭-এর বিধানসভা নির্বাচনে বহুজনসমাজ পার্টি উত্তরপ্রদেশে যে চমকপ্রদ ও রুদ্ধশ্বাস সাফল্য অর্জন করেছিল, তার মূলে ছিল মায়াবতীর সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং, যা তিনি বিহারের লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার এবং উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিংহের কাছ থেকে শিখেছিলেন। ব্যাপক হারে ব্রাহ্মণ, ঠাকুর ও মুসলিমদের প্রার্থী করে তিনি সে দিন বহুজনসমাজকে সর্বজন সমাজের ব্যাপ্তি ও প্রসারের দিকে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে কাঁসিরামের বহুজনসমাজের বৃত্ত থেকেই তিনি সরে আসেন। তাঁর অধৈর্য ও অসহিষ্ণু রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাপিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের দিকে উড়ান দেয়। প্রকাশ কারাটের মতো কিছু উচ্চবর্গীয় তাতে প্রচ্ছন্ন ইন্ধনও জুগিয়ে চলেন। ‘বহেনজি’ তাঁর জাতভাইদের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে বর্ণহিন্দু আমলাদের দ্বারা পরিবৃত হতে থাকেন। কঠোর নিরাপত্তা-বেষ্টিত বহেনজির দেখা পান না দলিতরা। এই জনবিচ্ছিন্নতা ও তার আনুষঙ্গিক অহঙ্কারই তাঁর কাল হয়।
কাঁসি রাম তিল-তিল করে দলিত ক্ষমতায়নের একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেই আন্দোলনের বর্শামুখ ছিল হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণীয় আধিপত্য হ্রাস করার দিকে নিবদ্ধ। রাজনীতির মণ্ডলায়নের অনেক আগেই সেই সামাজিক প্রত্যাঘাতের বজ্রনির্ঘোষ ছিল ‘তিলক, তরাজু অউর তলোয়ার/ ইনকো মারো জুতে চার’। সমগ্র আর্যাবর্তেই দলিত চেতনায় এই রণধ্বনি উতরোল ঢেউ তোলে। কাঁসি রামের অভিভাবকত্ব থেকে সাবালকত্ব পেয়ে মায়াবতী যখন তার অভিঘাতের রাজনৈতিক সুফলগুলি সংহত করতে লাগলেন, তখন থেকেই দলিতের শ্রেণিগত ও গোষ্ঠীগত ক্ষমতায়নের প্রকল্প ও প্রক্রিয়া তাঁর শিলীভূত পাথরপ্রতিমায় স্তব্ধ হতে শুরু করল। স্তব্ধ এবং অনড়, অচঞ্চল।
ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর মায়াবতীর মনে হল, ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াকে গভীর ও ব্যাপকতর করার আর প্রয়োজন নেই। কাঁসি রাম চেয়েছিলেন ‘মজবুত সরকার’ নয়, ‘মজবুর’ অর্থাৎ দুর্বল সরকার, যে-সরকারের সঙ্গে দলিতরা দরকষাকষি করে নিজেদের প্রাপ্যের ভাগ বাড়িয়ে নিতে পারে। কিন্তু মায়াবতী সরকার গড়েই নিজের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে লাগলেন। যেন ব্যক্তিগত ভাবে ‘চামার কি বেটি’র মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভের সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিগত ভাবে দলিতের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াও সাঙ্গ, অতএব অপ্রাসঙ্গিক। এখন আর দলিতদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, কর্মসংস্থানের সমস্যাগুলোর মীমাংসা করার প্রয়োজন নেই। দরকার নেই সুশাসনের, জনকল্যাণের, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বা বিকাশের। কাঁসিরামের বক্তব্য ছিল সরকারের জমি আমাদের, দলিতদেরই জমি।
তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দলিতরা শহর-মফস্সল এলাকায় সরকারি জমি দখল করে সেখানে ঝুগ্গি-ঝোপড়ি, দোকান বানাতে থাকে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মায়াবতীর পক্ষে এমন জবরদখলে প্ররোচনা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কাঁসি রামের কথার মূল ভাব অনুসরণ করে তিনি রাজ্যে ভূমি-সংস্কারের কর্মসূচি হাতে নিতে পারতেন। পাঁচ বছরে সে পথে কোনও অগ্রগতি বা ভাবনাও দেখা গেল না। কাঁসি রাম সর্বোপরি চেয়েছিলেন, দলীয় কমিটিগুলি দলিত ক্ষমতায়নের নীতি-কর্মসূচি নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা-বিতর্কে মেতে উঠুক, দলিতের মেধা ও মননের বিকাশ হোক। মায়াবতীর অচলায়তন সে সব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়ে কেবল তাঁর মহিমা প্রচারের দিকে মনোনিবেশ করে। কাঁসি রামের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বহুজনসমাজ পার্টি গড়ে তোলা একের পর এক প্রবীণ নেতা দল ছাড়তে বা দল থেকে বিতাড়িত হতে লাগলেন। নিষ্কণ্টক, সমালোচকমুক্ত, লোকনিন্দাভয়রহিত মায়াবতী এখন কেবল নিজের বৈভব ও বিত্ত সংগ্রহে মন দিতে পারেন, সেই সঙ্গে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলায়। রক্তমাংসের মায়াবতী সমর্থক ও বশংবদদের উচ্চকিত জয়ধ্বনির মধ্যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে একের পর এক নোটের মালা পরতে লাগলেন, নিজের জন্মদিনের সাড়ম্বর, বর্ণাঢ্য ও ব্যয়বহুল উদ্যাপনে মেতে উঠলেন। আর রাজ্য জুড়ে গজিয়ে উঠতে লাগল তাঁর মর্মর মূর্তি। যেন মূর্তির মধ্যেই ভাবমূর্তিও লুকিয়ে থাকে কিংবা প্রকট হয়! সেই সব বিশাল মূর্তির দিকে তাকাতে হলে শিরদাঁড়া ঋজু রাখা যায় না, ঘাড় পিছনে হেলাতে হয়। তাকালে সম্ভ্রম জাগে, সমীহও, হয়তো কিছুটা ভয়ও। হীন-পতিতের ঈশ্বরী হতে চাওয়া বহেনজি এই ধুলোমাখা পৃথিবীর দলিত অসম্মান থেকে অনেক ওপরের বেদিমূলে প্রস্তরীভূত হয়ে থাকেন। দলিত জাতভাইরা আর তাঁর অহঙ্কারের নাগাল পায় না। কেবল মিশ্র-জাতীয় ব্রাহ্মণের জন্য তাঁর প্রহরীবেষ্টিত প্রাসাদের অবারিতদ্বার।
রাজ্য জুড়ে বহেনজির পাথরপ্রতিমা ছড়ানো। দলিতরা তাঁর কাছে আর পৌঁছতে পারে না। তাই কি অনুরাগীদের কাছে নিজেকে অধরা করেও নিজের বিগ্রহের মাধ্যমে তাদের কাছে ধরা দিতে চেয়েছিলেন তিনি? চালু করতে চেয়েছিলেন নিজের পূজা? উচ্চবর্ণের আইকনদের ছড়ানো মূর্তিমালার প্রতিদ্বন্দ্বে স্থাপন করেছিলেন দলিত আইকনদের মন্দির, যেখানে দৈব মহিমায় মণ্ডিত প্যান্থিয়নে অম্বেডকর, পেরিয়ার, কাঁসি রামের সমান্তরাল স্তরবিন্যাসে নিজেকেও প্রতিষ্ঠা করা যায়? বুদ্ধের আইকনোগ্রাফিতে নিজেকে ঢোকানো যায় না বলে নিজের আইকনোগ্রাফিতে বুদ্ধকে জায়গা করে দেওয়াও কি সে জন্যই?
তবু কী আশ্চর্য, এত প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ ও কথার খেলাপের পরেও, মায়াবতীর দলিত ভোটব্যাংকের শাঁসটা অক্ষতই রয়েছে! যে-নির্বাচন তাঁকে লখনউ থেকে নির্বাসিত করেছে, তাতেও ২৬ শতাংশ ভোট বহুজনপার্টির বাক্সে জমা পড়েছে। তবে কি বহেনজি এখনও দলিত মসিহাই রয়ে গেছেন? ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, অন্তত দলিতরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি? সংখ্যালঘুরা তাঁকে বিলক্ষণ ছেড়ে গেছে। ব্রাহ্মণ-ঠাকুরদের মধ্যে যারা যাদব-আধিপত্যে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর প্রসারিত আলিঙ্গনে একদা ধরা দিয়েছিল, তারা তো কোনও জাতপ্রেম থেকে দলিতের উঠোনে এসে দাঁড়ায়নি, বরং তাদের সহজাত জাতক্রোধ বহেনজির অসংস্কৃত আত্মম্ভরিতায় বিরক্ত হয়ে দ্রুত স্বস্থানে ফিরেছে। আর যাদব-কুর্মিদের যে-অংশ তাঁর সর্বজনসমাজের ধারণায় আকৃষ্ট হয়েছিল, দলিতের রাজনৈতিক প্রাধান্য বেশি দিন শিরোধার্য করা তাদের পক্ষেও কঠিন, অন্যান্যদের মতো তারাও সরে গিয়ে ভিড় বাড়িয়েছে মুলায়ম-অখিলেশের শিবিরে। শুধু দলিতরাই এখনও অভিমানে মুখ ফেরায়নি।
এরা সেই দীনাতিদীন, কাঁসি রাম যাদের ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ায় শামিল করেছিলেন, শিরদাঁড়া সোজা করে মাথা তুলে দাঁড়াতে, উচ্চবর্ণের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শিখিয়েছিলেন। অবমানবের খণ্ডিত সত্তার গ্লানি ও অসম্মান ঝেড়ে ফেলে পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা ও অধিকারে বাঁচবার সাহস জুগিয়েছিলেন। এরা যত দিন মায়াবতীর সঙ্গে থাকবে, তত দিন তাঁকে আর্যাবর্তের রাজনীতি থেকে মুছে ফেলা যাবে না। তবে সে জন্য মায়াবতীকেও তাঁর উচ্চবর্ণসুলভ আরোপিত গরিমার গজদন্তমিনার থেকে ধূলিমলিন জাতভ-এর পর্ণকুটিরে নেমে আসতে হবে।
আইকন হয়ে ওঠার দূরত্বসূচক অন্তরাল ও আবরণের মোহজাল ছিঁড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হবে, হয়ে উঠতে হবে দলিতের যথার্থ বহেনজি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.