আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁহার অভিষেকের লগ্নটি অন্য এক মহাতারকার আবির্ভাবের ছটায় ঢাকা পড়িয়া গিয়াছিল। দেড় দশক পরে, তিনি যখন স্বেচ্ছায় সেই মঞ্চ ত্যাগ করিলেন, তখনও অস্ট্রেলিয়ায় সদ্য সমাপ্ত সফরের পরিপূর্ণ ব্যর্থতার মেঘ সরিয়া সূর্যালোকে স্নাত হওয়া তাঁহার হইল না। কিন্তু, রাহুল শরদ দ্রাবিড়, তাঁহার অননুকরণীয় ভঙ্গিমায়, তাঁহার ইংরাজসুলভ ‘আন্ডারস্টেটমেন্টে’ একটি কথা বলিয়া গেলেন এখনও, এই প্রবল বাণিজ্যায়নের মহামেলাতেও, কেহ চাহিলে তাঁহার স্বকীয়তা বজায় রাখিতে পারেন। গড্ডলিকা প্রবাহের অংশী না হওয়া, স্রোতের বিপরীতে হাঁটা অসম্ভব নহে। হ্যাঁ, তাহাতে চারিত্রিক জোর প্রয়োজন। ক্রিজের বিপরীত প্রান্তে সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বা ভি ভি এস লক্ষ্মণ চোখধাঁধানো ব্যাটিং করিতেছেন, সম্মিলিত হাততালি কেবল তাঁহাদের জন্যই বরাদ্দ হইতেছে দেখিয়াও নিজের খেলাটুকু খেলিতে পারা সহজ কথা নহে। রাহুল দ্রাবিড় তাহা করিয়া দেখাইয়াছেন। অজস্র বার। নিজের জন্য গণ্ডি বাঁধিয়া দিয়া সেই গণ্ডির মর্যাদা প্রাণপণে রক্ষা করিয়া যাওয়াই রাহুল দ্রাবিড়ের অভিজ্ঞান। এইখানেই তিনি ক্রিকেটের পরিসীমাকে অতিক্রম করিয়া এক বৃহত্তর মহাকাব্যের নায়ক হইয়া উঠেন। সম্ভবত, ট্র্যাজিক নায়ক। তিনি এক বার বলিয়াছিলেন, তিনি মাঠে নামামাত্র দর্শকরা অপেক্ষা করিয়া থাকেন, কখন তিনি আউট হইবেন। কারণ, তিনি আউট হইলে যিনি মাঠে নামিবেন, তাঁহার নাম সচিন তেন্ডুলকর। রাহুল দ্রাবিড় তাঁহার সমগ্র ক্রিকেট জীবন এই ‘সচিন তেন্ডুলকর’-এর ‘অপর’ হইয়া থাকিলেন। তিনি ‘দ্বিতীয় সচিন’ হইতে চাহেন নাই। তাঁহার সাধনা ছিল রাহুল দ্রাবিড় হওয়ার। তিনি সেই সাধনায় উত্তীর্ণ। ক্রিকেট এক কালে ভদ্রলোকের খেলা হিসাবে পরিচিত ছিল। রাহুল দ্রাবিড় সম্ভবত সেই খেলার শেষ প্রতিনিধি। এক জন ক্রিকেটারের সম্ভ্রমবোধ কী রকম হওয়া উচিত, তাঁহার আচরণ কতখানি সংযত হওয়া বিধেয় ভারতীয় ক্রিকেট হইতে এই মাপকাঠিগুলি রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গেই অবসরে যাইতে পারে। রাহুল দ্রাবিড় খেলার মাঠে যেমন ছিলেন, ব্যক্তিজীবনেও তেমনই। উচ্ছ্বাস তাঁহাকে ভাসাইয়া লইয়া যাইতে পারে না। সাফল্য তাঁহাকে অসংযত করে না। তাঁহার ব্যক্তিজীবনও একটি সাধনা ব্যতিক্রমী হইবার। এবং, মাঠের বাহিরেও তিনি প্রমাণ করিলেন, ইচ্ছা থাকিলে এই আকালেও ভদ্রজনসুলভ সংযত জীবনযাপন সম্ভব। তাঁহার ক্রিকেটীয় দক্ষতা সম্ভবত অননুকরণীয়, অন্তত বেশির ভাগের পক্ষে। কিন্তু, তাঁহার জীবনযাপন হইতে না শিখিলে আমাদের ক্ষতি। নিজের কর্তব্যে অবিচলিত থাকা, তাৎক্ষণিক প্রশংসার লোভে, আর্থিক প্রলোভনে ভাসিয়া না যাওয়ার শিক্ষার প্রয়োগ শুধু ক্রিকেটের মাঠে হয় না। রাহুল দ্রাবিড়ের শিক্ষাটি ক্রিকেটের মাঠের পরিধির তুলনায় বড়। এই শিক্ষা জীবনের। রাহুল দ্রাবিড় ক্রিকেট মাঠের মহানায়ক হিসাবে খেলা ছাড়িতে পারিলেন কি না, সেই প্রশ্নও, অতএব, অবান্তর। তিনি আরও বড় মাঠে নায়কের মর্যাদা পাইয়াছেন। যথেষ্ট ইচ্ছা থাকিলে নিজের মতো হওয়া সম্ভব এই বিশ্বাসটিকে তিনি ভরসা দিলেন। |