মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে যখন এক নতুন তৃতীয় ফ্রন্টের সম্ভাবনা জোরদার হয়ে উঠেছে, তখন সিপিএমের রণকৌশল কী হবে, তাই নিয়ে দলের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
বাম দলগুলির একটা অংশের পাশাপাশি সিপিএমের একটা বড় অংশও মনে করছে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এখনই অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলগুলির সঙ্গে জোট তৈরির চেষ্টা শুরু করা উচিত। প্রকাশ কারাট অবশ্য এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে আগে দলের শক্তি বাড়াতে আগ্রহী। তাঁর মতে, প্রথমে দলের নিজস্ব আন্দোলন গড়ে তুলে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা উচিত। তার পরে প্রয়োজনে লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের শক্তি অনুযায়ী কৌশলগত জোটে যাওয়া পেতে পারে।
কারাট ‘ধীরে চলো’ নীতি নিলেও জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্রের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতের অভিযোগ তুলে নতুন তৃতীয় ফ্রন্টের সম্ভাবনা উসকে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনিতেই পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়েক মমতার সঙ্গে সমন্বয় তৈরি করেই এগোনোর চেষ্টা করছিলেন। এরই মধ্যে জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্রের বিষয়টি এসে যাওয়ায় তাঁরা একজোট হয়ে গিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন জয়ললিতাও। চন্দ্রবাবু নায়ডুর সমর্থন পেয়েছেন মমতা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রশ্নে নতুন করে তৃতীয় ফ্রন্টের ভাবনার উদয় হয়েছে।
সেখানেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে সিপিএমের মধ্যে। কমিউনিস্ট পার্টির কাছে বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক অন্যতম প্রিয় তাত্ত্বিক বিষয়। এ বিষয়ে সিপিএমের মতাদর্শগত অবস্থান সম্পর্কে দীর্ঘ দলিলও রয়েছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাতের প্রশ্নে তাঁদের সরব না হয়ে উপায় নেই। সিপিএম এমনিতে কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা ব্যবস্থার পক্ষে হলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যকে আরও বেশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলে। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে যে সব দলগুলিকে নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্টের সম্ভাবনা জোরদার হচ্ছে, তাদের নিয়ে এর আগে সিপিএমও বারবার তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করেছে। এই পরিস্থিতিতে সিপিএমের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, দল কি এখন কোণে বসে হাত কামড়াবে? দলেরই একাংশের মত হল, সিপিএমই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক তথা তৃতীয় ফ্রন্ট নিয়ে এত দিন নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে এসেছে। এখন মমতা যা বলছেন, সেটা দর কষাকষির কৌশলমাত্র। এর পিছনে কোনও সুচিন্তিত, ধারাবাহিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ নেই। ফলে মমতাকে পালের হাওয়া কাড়তে দেওয়ার কোনও মানে হয় না বলে তাঁদের দাবি।
সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক এ বি বর্ধন আজ দাবি তুলেছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করে দেওয়া প্রয়োজন। আজ এক দলীয় সভায় তিনি জানান, সমাজবাদী পার্টি, বিজু জনতা দল, এডিএমকে-র মতো অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে জোট তৈরির চেষ্টা করতে হবে। সিপিএম এই দলগুলির সঙ্গে সময়ে সময়ে ইস্যুভিত্তিক জোট বা নির্বাচনী সমঝোতার পক্ষে থাকলেও, তাদের মূলত রাজনৈতিক সুবিধাবাদী বলেই মনে করে। সে কথা মানলেও বর্ধনের যুক্তি, “আমরা সবাইকে চারিত্রিক শংসাপত্র দিতে আসিনি।” সিপিএমেরও একটা অংশের প্রশ্ন হল, কেন সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে উত্তরপ্রদেশে জোটের চেষ্টা করা হল না?
প্রকাশ কারাট কিন্তু মনে করছেন, দলের নিজস্ব শক্তি না থাকলে কারও সঙ্গে আসন সমঝোতায় গিয়ে লাভ নেই। তাতে দলের ক্ষতিই হবে। সিপিএম নিজে দুর্বল হলে অন্য দলই ছড়ি ঘোরাবে। এমনকী সিপিএমে ভাঙন ধরানোরও চেষ্টা করবে। অতীতে হিন্দি বলয়ে সিপিআইকে ঠিক এই মাসুলই গুনতে হয়েছে। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক মনে করছেন দলের প্রভাব শুধু তিন রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, অথচ তারা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও নেবে, এমন আশা করাটা অবাস্তব। তার থেকে ধীরে ধীরে দলের শক্তি বাড়ানো এবং কংগ্রেসের উদার আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করাই উচিত। বাম দলগুলির বাইরে দেশের নানা অংশে যে সব বামপন্থী চরিত্রের জনআন্দোলন হচ্ছে, তাতে অংশ নিয়ে দলের ভিত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করার পক্ষে তিনি। তার জন্যই আগামী পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’-এর কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হল, জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে মমতা, নবীন, জয়ললিতা, চন্দ্রবাবুর দলের সাংসদরা লোকসভা বা র্যজসভায় সরব হলে বামেদের তাতে গলা মেলানো ছাড়া উপায় থাকবে না। সিপিএমের পক্ষে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সুর নেওয়া সম্ভব?
সিপিএম নেতারা যুক্তি দিচ্ছেন, জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন নবীন পট্টনায়েক। তিনিই অন্যান্য মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা নবীনের আপত্তিকেই সমর্থন জানাবেন। ঠিক সেই পথেই আজ মমতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে, সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য বিমান বসু বলেন, “আমরা রাজ্যের অধিকার নিয়ে অনেক দিন ধরেই বলে আসছি। এখন নবীন পট্টনায়েক এ বিষয়ে সরব হয়েছেন।” |